বুধবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

বানানের টিপস্ | স্বপন ভট্টাচার্য

স্বপন ভট্টাচার্য

বানানের টিপস্ (১)

মুখস্থ / মুখস্ত

এই বানানটা লিখতে গিয়ে আমরা প্রায়ই সংশয়ে ভুগি। কী লিখব? 'মুখস্থ' না 'মুখস্ত'? আমরা যদি শব্দের মানেটা ঠিক বুঝতে পারি তাহলেই আমরা এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব। আগে দেখে নেওয়া যাক 'মুখস্থ' শব্দটির অর্থ কী? মুখস্থ মানে মুখে স্থিত। 'স্থিত' বা 'স্থ' মানে আছে, বর্তমান বা প্রতিষ্ঠিত। 'স্থ' শব্দটি একটি বিশেষণ। মুখে আছে তাই মুখস্থ। ঠিক তেমনি নগরস্থ, নিম্নস্থ, অধীনস্থ, কলকাতাস্থ, ঢাকাস্থ, পদস্থ, কণ্ঠস্থ, দুঃস্থ, পার্শ্বস্থ ইত্যাদি।

তাহলে আমাদের ভুল হয় কেন? কারণ আর একটি শব্দ আছে 'গ্রস্ত', এটিও বিশেষণ। এর অর্থ গ্রাস করেছে এমন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিকারগ্রস্ত, রোগগ্রস্ত, শোকগ্রস্ত ইত্যাদি। এই শব্দগুলোতে আমরা বুঝতে পারছি বিকার, রোগ বা শোক গ্রাস করেছে এমন ব্যক্তি। 

'স্থ' না 'স্ত' কোনটা লিখব এ বিষয়ে একটা সহজ নিয়মের কথা বলি। প্রথমেই' স্থ' অথবা 'স্ত' বাদ দিন। এবার দেখুন শব্দটার কোন মানে আছে কি? যদি থাকে 'স্থ' বসিয়ে দিন আর না থাকলে 'স্ত' বসান। যেমন, মুখস্থ শব্দ থেকে 'স্থ' বাদ দিলে থাকবে 'মুখ' যা একটি অর্থপূর্ণ শব্দ। কিন্তু বিকারগ্রস্ত শব্দ থেকে 'স্ত' সরিয়ে নিলে পড়ে থাকে 'বিকারগ্র' যার কোন মানে নেই। তাই এখানে হবে 'স্ত'। আরও মনে রাখা দরকার যে 'স্থ' একটি অর্থপূর্ণ শব্দ হলেও 'স্ত' শব্দটির আলাদা কোন অর্থ নেই। 

তবে আবার দেখতে হবে 'দুরস্ত' আর 'দূরস্থ' গুলিয়ে না যায়। দুরস্ত শব্দের মানে পরিপাটি, সুশৃঙ্খল। যেমন, কেতাদুরস্ত। আর দূরস্থ মানে দূরে আছে।

বানানের টিপস্ (২)

লক্ষ / লক্ষ্য / লক্ষণীয়

এই শব্দগুলোর বানান লিখতে গিয়ে আমাদের প্রায়ই ভুল হয়ে যায়। 'লক্ষ' লিখতে গিয়ে 'লক্ষ্য' লিখে ফেলি আবার এর উল্টোটাও কখনও কখনও হয়ে যায়। এছাড়াও আমরা অনেক সময়ই 'লক্ষণীয়' শব্দে একটা বাড়তি য-ফলা লাগিয়ে  'লক্ষ্যণীয়' লিখে ফেলি। আসুন, আমরা সঠিক বানানগুলো এবং সেগুলোর সঠিক ব্যবহার শিখে নিই।

লক্ষ - লক্ষ শব্দটা যেখানে একটা সংখ্যা (শত সহস্র) তখন তার বানান আমরা লিখব 'লক্ষ'। সাধারণত এই বানানটা লিখতে আমাদের খুব একটা ভুল হয় না।

লক্ষ - লক্ষ যেখানে একটা ক্রিয়াপদ সেই বানানে আমরা প্রায়ই ভুল করে 'লক্ষ্য' লিখে ফেলি। এই বানানটা লিখতে গিয়েই আমাদের ভুল হয় সবচেয়ে বেশি। লক্ষ রাখতে হবে যে লক্ষ করা বা লক্ষ রাখা এই ধরনের ক্রিয়াপদ লিখতে গিয়ে আমরা যেন কখনই বাড়তি য-ফলা না দিয়ে দিই।

লক্ষ্য - লক্ষ্য শব্দটা যেখানে ক্রিয়াপদ বা সংখ্যাবাচক নয় সেখানে য-ফলা দিতেই হবে। কারণ 'লক্ষ্' ধাতুর সঙ্গে য লাগিয়েই শব্দটা তৈরি  হয়েছে। যেমন, আমার 'লক্ষ্য' শুদ্ধ বানান শেখা। অর্জুনের লক্ষ্য  মাছের চোখ। কিন্তু  'অর্জুন মাছের চোখের দিকে লক্ষ করল।'

লক্ষণীয় - 'লক্ষ্+অনীয় = লক্ষণীয়। এই বানানে য-ফলা নেই।

"লক্ষণীয় বিষয় হল যে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বিদ্যালয়গুলো লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীদের একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করে। আরও লক্ষ করা গেছে যে বেশ কিছু বিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্য অর্থ উপার্জন যদিও প্রকৃত শিক্ষাদানই বিদ্যালয়গুলোর লক্ষ্য হওয়া উচিত।"

বানানের টিপস্ (৩)

বান/বতী, মান/মতী

রূপবান, দয়াবান,  ভক্তিমান এই ধরনের শব্দগুলো আমরা প্রায়ই ব্যবহার করি। এই শব্দগুলো আবার স্ত্রীলিঙ্গে রূপবতী, দয়াবতী বা ভক্তিমতী হয়ে যায়। এখন প্রশ্ন হল কোথায় 'বান' আর কোথায় 'মান' লিখব এর কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম আছে কি? 'বতুপ', 'মতুপ' প্রত্যয়ের আলোচনাতে না গিয়ে সহজভাবে বলা যায় রে আছে বোঝাতে 'বান'  বা 'মান' ব্যবহার হচ্ছে। যেমন :- রূপ আছে যার রূপবান (রূপবতী), দয়া আছে যার দয়াবান (দয়াবতী), এছাড়াও সরস্ অর্থাৎ জল আছে তাই সরস্বতী (লিঙ্গান্তরে সরস্বান - যদিও বাংলায় এই শব্দের ব্যবহার প্রায় নেই)। আবার গুণ আছে যার গুণবান (গুণবতী)।  কিন্তু শক্তি আছে যার শক্তিমান (শক্তিমতী), ভক্তি আছে যার ভক্তিমান (ভক্তিমতী)। 

উপরের উদাহরণগুলো লক্ষ করলে দেখা যাবে যে মূল শব্দটা অ-কারান্ত বা আ-কারান্ত হলে বান বা বতী আর অন্য স্বর মূল শব্দের শেষে থাকলে মান বা মতী হচ্ছে।

ব্যতিক্রম 'লক্ষ্মীবান'। তবে বর্তমান, বর্ধমান এই শব্দগুলো কিন্তু ব্যতিক্রম নয়, কারণ এখানে আছে এই অর্থে 'মান' ব্যবহার হচ্ছে না। এগুলোতে অন্য প্রত্যয় যুক্ত হয়েছে।

বানানের টিপস্ (৪)

রেফ

কোনও ব্যঞ্জন বর্ণের পরে যুক্তভাবে র বর্ণটি এলে তাকে আমরা বলি র-ফলা। আর তা যদি আগে আসে? তখন আমরা তাকে বলি 'রেফ'। আজ যদি আমরা কোন পুরোন বইয়ের পাতা ওল্টাই, তাহলে আমরা সেখানে লক্ষ করব ধর্ম্ম, কর্ম্ম, সার্ব্বিক এই ধরনের শব্দগুলো।

আজ থেকে প্রায় পঁচাশি বছর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সংস্কার সমিতি নির্দেশ দিয়েছে যে রেফ-এর পর কোন বর্ণের দ্বিত্ব হবে না। সেই সময়কার প্রায় সব লেখকই এই দ্বিত্ব বর্জন প্রথা মেনে নিলেও আমাদের মত সাধারণ মানুষেরা কিন্তু এই প্রথা মানতে অনেক সময় নিয়েছিলাম। কিন্তু আজও আমরা আচার্য, কার্য, কার্যালয়, ধৈর্য, সৌন্দর্য এই শব্দগুলোতে নির্বিচারে একটা বাড়তি য-ফলা লাগিয়ে দিচ্ছি। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটা কথা মনে পড়ে গেল। বানান সংস্কার সমিতির সদস্যদের মধ্যে দু'তিনজন যখন রবীন্দ্রনাথকে এই নিয়মের কথা বলে তাঁকে ঐ নিয়ম মেনে লেখার অনুরোধ জানান তখন রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ' দু দু'জন "ভট্টাচার্য্য" বংশীয় মানুষ যখন স্বেচ্ছায় তাঁদের লেজ ছেঁটে ফেলতে রাজি হয়েছেন তখন আমি আর আপত্তি করি কেন?' 
প্রসঙ্গত ওই কমিটিতে দুজনের পদবি ছিল ভট্টাচার্য। 

আসলে 'য্য' যে য-বর্ণের দ্বিত্ব তা আমরা সবসময় মনে রাখি না। তাই আমরা আর রেফ-এর পর 'য্য' লিখব না। অর্থাৎ কার্য্য, আচার্য্য, ভট্টাচার্য্য, ধৈর্য্য এসব আর লিখব না। শুধু তাই নয় রেফ-এর পর কোনও বর্ণেই দ্বিত্ব দেব না, এমনকি 'কার্ত্তিক' শব্দটিকেও কার্তিক লিখব।

বানানের টিপস্ (৫)

'ঞ্চ', 'ঞ্ছ', 'ঞ্জ', 'ঞ্ঝ' 

উপরের চারটেই যুক্তব্যঞ্জন অর্থাৎ এগুলো ভাঙলে দুটো করে ব্যঞ্জনবর্ণ আমরা পাব। কিন্তু কোন কোন ব্যঞ্জন তা প্রথম তিনটে যুক্তব্যঞ্জনের  চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই। শেষেরটা যে ঞ+ঝ তা কিন্তু দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আধুনিক লিপি পদ্ধতিতে এগুলো এমনভাবে লেখার নিয়ম যাতে দেখেই বোঝা যায় যে ব্যঞ্জনগুলো কী কী। সে যাই হোক, এগুলো আমরা উচ্চারণ করি ন্+চ, ন্+ছ ,  ন্+জ এবং ন্+ঝ এভাবেই। আর তার ফলে অনেক সময়ই আমরা এই যুক্তব্যঞ্জনগুলো লিখবার সময় ভুল করে ফেলি। আবার প্রান্ত, গ্রন্থ, মন্দা, গন্ধ এই শব্দগুলোর শেষের যুক্তব্যঞ্জনগুলোর উচ্চারণ‌ও কিন্তু যথাক্রমে ন+ত, ন+থ, ন+দ এবং ন+ধ। তাহলে আমরা মনে রাখব কীভাবে? তাহলে কখন 'ঞ' লিখব আর কখন‌ই বা 'ন' লিখব তা বুঝব কীভাবে?

আসলে আমাদের মধ্যে যেমন দলাদলি, স্বজনপোষণ আছে এই বর্ণগুলোর মধ্যেও কিন্তু তেমন আছে। অর্থাৎ 'চ'-বর্গের প্রথম চারটে বর্ণ যদি আগে কোনো আনুনাসিক বর্ণ নিয়ে যুক্তব্যঞ্জন তৈরি করে তবে তারা সবসময়ই তাদের দলের অর্থাৎ সেই বর্গের শেষের বর্ণটাকেই বেছে নেবে। তাই কাঞ্চন, বাঞ্ছিত, মৃত্যুঞ্জয় বা ঝঞ্ঝা এসব শব্দের চ-বর্গের বর্ণগুলো ঞ ছাড়া আর কাউকে সঙ্গে নেবে না। 

ঠিক তেমনি ক-বর্গের বর্ণগুলো বেছে নেবে 'ঙ'। অঙ্ক, শঙ্খ, বঙ্গ, সঙ্ঘ এই শব্দগুলো লক্ষ করলেই বোঝা যাবে যে ক,খ,গ বা ঘ এরা ঙ কে সঙ্গে নেওয়া পছন্দ করছে। (শুধু  সন্ধিজাত শব্দ হলে ঙ-র জায়গায় অনুস্বার ব্যবহার করা যায়। যেমন :- শঙ্কর, শংকর বা সঙ্গীত, সংগীত।) তাই মনে রাখা দরকার যে  সন্ধিজাত শব্দ না হলে আমরা সবসময় ক-বর্গের বর্ণগুলোর সঙ্গে শুধুমাত্র 'ঙ' ব্যবহার করব।

তৎসম শব্দে ট-বর্গের বর্ণগুলোর সঙ্গে থাকবে 'ণ'। যেমন:- ঘণ্টা, পণ্ডিত। 

ত-বর্গের ত, থ, দ, ধ এরা আবার 'ন' ছাড়া কাউকে নেবে না। যেমন:- দুরন্ত, পান্থ, সুন্দর, বন্ধ। প, ফ, ব, ভ সবসময় চাইবে ম-কে। যেমন:- কম্পন, লম্ফ, কম্বল, সম্ভব। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে 'কিংবা', 'সংবাদ', 'বারংবার' এইসব বানানে অনুস্বার কেন? কারণ এই 'ব' বর্গীয় অর্থাৎ প-বর্গের বর্ণ নয়‌। আর বর্গীয় বর্গের বাইরের বর্ণ হলে আমরা লিখব অনুস্বার। যেমন:- সংশোধন, নৃশংস, সংহতি ইত্যাদি।

বানানের টিপস্ (৬)

কী / কি

প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে কী/কি নির্বিচারে ব্যবহার করা হত। বিদ্যাপতি থেকে শুরু করে অনেক পদকার‌ই এর নজির রেখে গিয়েছেন ‌কিন্তু ইদানীং এ বিষয়ে একটা নির্দিষ্ট নিয়ম তৈরি করা হয়েছে। নিয়মটা কী একটু দেখে নেওয়া যাক। 

ছোটবেলায় স্কুলে আমরা দেখেছি যে প্রশ্ন দেওয়া থাকলে তার উত্তর দিতে হত। আবার অনেক সময় উত্তর দেওয়া থাকলে সেই উত্তরের উপর ভিত্তি করে আমারা প্রশ্ন তৈরি করতাম। এখানেও আমাদের প্রশ্নবোধক কি/কী শিখতে হলে দ্বিতীয় পন্থা নিতে হবে। অর্থাৎ আগে সম্ভাব্য  উত্তর ভেবে নিয়ে প্রশ্নে কি অথবা কী বসাতে হবে। 

কীভাবে? যদি দেখা যায় যে প্রশ্নটার উত্তর শুধুমাত্র 'হ্যাঁ' অথবা 'না' দিয়ে দেওয়া সম্ভব তবে সেই প্রশ্নে 'কি' বসিয়ে দিন। আর তার না হলে 'কী' বসান। 

যদি উত্তর হয়, 'আমি মাছ ভাত খাব', অথবা ডাল রুটি খাব'  তবে প্রশ্ন হবে, 'তুমি কী  খাবে?' আর যদি শুধু 'হ্যাঁ' অথবা 'না' দিয়ে আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়, তবে প্রশ্ন করুন 'তুমি কি খাবে?' 

আর একটা কথা মনে রাখা দরকার 'কীভাবে', 'কীরূপে' এগুলো সবসময় ঈ-কার দিয়েই লিখতে হবে কারণ এই ধরনের প্রশ্নের কখন‌ই  'হ্যাঁ' অথবা 'না' দিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।

বানানের টিপস্ (৭)

বেশি/বেশী

কী লিখব 'বেশি' না 'বেশী'? বিভিন্ন লেখায় তো এই দুই বানান‌ই দেখা যায়। তাহলে আমরা কখন কোনটা লিখব? 

'বেশি' শব্দটা যখন আমরা অধিক বা অতিরিক্ত অর্থে ব্যবহার করব তখন লিখব 'বেশি'। যেমন:- 'এর বেশি আমি আর কিছু চাই না', 'সে অনেক বেশি উপার্জন করে' বা 'বছরের কয়েক মাস দিনের তুলনায় রাত বেশি বড় হয়' ইত্যাদি।

আবার যদি বেশধারী অর্থে ব্যবহার করা হয় তবে লিখব 'বেশী'। যেমন:- 'ভদ্রবেশী মানুষ হলেই তাকে বিশ্বাস করা উচিত নয়', 'ওই সাধুবেশী লোকটিকে অনেকেই নেতাজি বলে ভুল করে', 'এরা তো ছদ্মবেশী' ইত্যাদি। বাংলায় স্বতন্ত্রভাবে এই 'বেশী' শব্দটার ব্যবহার খুবই কম, প্রায় নেই বললেই চলে।

কিন্তু কেন? কারণ অধিক অর্থে 'বেশি' শব্দটা ফারসি শব্দ আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সংস্কার সমিতির নির্দেশ অনুসারে আমরা অতৎসম শব্দে দীর্ঘস্বর ব্যবহার করব না, তাই লিখব 'বেশি'। আর অন্যদিকে বেশধারী বা 'বেশী' শব্দটা তৎসম শব্দ।

আর একটা শব্দ আছে  'প্রতিবেশী' যার শেষে 'বেশী' শব্দটা থাকলেও তা কিন্তু ভিন্ন গোত্রের। প্রতিবেশে মানে নিকটবর্তী স্থানে থাকে যে সে 'প্রতিবেশী'।

বানানের টিপস্ ( ৮ )
- স্বপন ভট্টাচার্য

হয়নি, হয় নাই, হয় না

কিছু শব্দ লিখতে গেলেই আমরা দ্বিধায় পড়ে যাই। কী লিখব?  নি, নাই, না, নেই এই সব নঞর্থক শব্দগুলো কীভাবে লেখা উচিত?  এগুলোর মধ্যে নাই, না এবং নেই এই শব্দগুলোর আলাদা অর্থ  এবং আলাদা করে এগুলোর ব্যবহার থাকলেও 'নি' শব্দটার কোনো আলাদা মানে নেই। তাই 'নি' আমরা শব্দের সঙ্গে সাঁটিয়ে লিখব আর অন্যগুলো লিখব আলাদাভাবে। যেমন:- যদিও আমি গতকাল যেতে পারিনি তার মানে আগামীকাল‌ও যাব না এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
এখানে আর একটা বিষয় লক্ষ করা যেতে পারে, 'নি' অতীতকালে ব্যবহার হলেও 'না' বর্তমান, ভবিষ্যৎ যে কোনো কাল‌ই হতে পারে। তাছাড়া 'নি' (নাই), 'না' এগুলো ক্রিয়ার সঙ্গে থাকলেও 'নেই' সাধারণত শব্দের সঙ্গে ব্যবহার হয়। আবার সাধু ভাষায় 'করি নাই' (চলিতে - করিনি), সাধু ভাষায় 'বাড়ি নাই' (চলিতে - বাড়ি নেই)।

কখনও কখনও শব্দের আগে আমরা 'না' শব্দ ব্যবহার করি। তখন কিন্তু আমরা তা একই সঙ্গে লিখব। যেমন:- নাবালক, নাছোড়, নারাজ ইত্যাদি। আবার এই 'না' যদি ক্রিয়ার আগে বসাই তবে আমরা আলাদাভাবে লিখব অথবা একটা হাইফেন দিয়ে জুড়ে দেব। যেমন:- না বলা কথা (না-বলা কথা), না শোনা গান (না-শোনা গান), না গোনা তারা (না-গোনা তারা) ইত্যাদি।

অত‌এব আমরা  'নি' লিখব একসঙ্গে আর না, নেই আলাদাভাবে।

বানানের টিপস্ ( ৯ )
- স্বপন ভট্টাচার্য, কলকাতা 

সরকারি/সহকারী

এ এক মহা সমস্যা। শব্দের শেষাংশে 'কারি' থাকলে কী বানান লিখব। 'সরকারি' না 'সরকারী', 'সহকারি' না 'সহকারী'? আমরা লিখব সরকারি এবং সহকারী। কিন্তু কোন নিয়মে এই বানান লেখার পরামর্শ? 

নিয়মের কথায় পরে আসব। আগে একটা সহজ উপায় বলে দিই। আপনি যে শব্দটা লেখার কথা ভাবছেন তা কি কোনও ব্যক্তিকে বোঝাচ্ছে? যদি তা বোঝায় তাহলে নিশ্চিন্তে 'কারী' লিখুন। অর্থাৎ শব্দের শেষে দীর্ঘ ঈ-কার বসিয়ে দিন। লিখুন, সহকারী, অহংকারী, যোগাযোগকারী, ভ্রমণকারী, যোগদানকারী, তদন্তকারী, গণনাকারী, অবিমৃষ্যকারী, হঠকারী ইত্যাদি।

আর যদি ব্যক্তি না বুঝিয়ে অন্য কিছু বোঝায় তাহলে লিখুন, 'কারি'। যেমন:- সরকারি, দরকারি, তরকারি, কেলেংকারি, পাইকারি ইত্যাদি। 

কী বললেন? 'শিকারি'? এই তো বিপদে ফেললেন। ঠিকই তো, শিকারি তো কোনো ব্যক্তি হতেই পারেন। তবে তা  কিন্তু ব্যক্তি না হয়ে কোনো পশুও হতে পারে। এই বিষয়ে আপনাদের সঙ্গে আর একটা কথা শেয়ার করি। যদিও তা বানান সংক্রান্ত নয়।  যদি বলি, 'বাঘ শিকারি' তাহলে সেই ব্যক্তিকে বোঝাবে যিনি বাঘ শিকার করেন বা করেছেন। আর যদি বলি, 'শিকারি বাঘ' তাহলে কিন্তু সেই বাঘটাকে বোঝাবে যে শিকার করে। যাই হোক, এই শব্দটা আমরা নাহয় আলাদা করে মনে রাখব। এই রকম আরও কোনো শব্দ কি আপনাদের মনে পড়ছে? 

এবার কারণটা কী তা দেখে নেওয়া যাক। সরকারি, তরকারি ইত্যাদি শব্দ তৎসম শব্দ নয়। আর বাংলা বানানের নিয়ম অনুযায়ী তৎসম শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দে আমরা দীর্ঘ স্বর ব্যবহার করব না।

আর অন্যদিকে সহকারী, গণনাকারী ইত্যাদি কিন্তু তৎসম শব্দ।
[স্ট্যাটাস দাতা হিসেবে আমার কৈফিয়ত: এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি, বছর চারেক আগে এ বিষয়ে প্রথম আলো পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন শ্রদ্ধেয় ড. গোলাম মুরশিদ স্যার। প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল, যতদূর মনে পড়ে, "সহকারী সরকারি কর্মচারী"।]

#বানানের_টিপস্ (১০)

দরুন, দারুণ / ধরন, ধারণ
এই শব্দগুলো লিখতে গিয়ে আমরা প্রায়ই গুলিয়ে ফেলি। 'ন' এর জায়গায় 'ণ' আবার কখনও বা 'ণ' এর জায়গায় 'ন' বসিয়ে দিই।
আমরা জানি যে ণত্ববিধি অনুযায়ী ঋ, র আর ষ-এর পর 'ন' এলে তা হবে 'ণ'। সেই হিসেবে দারুণ বা ধারণ এই বানানগুলো ঠিকই আছে। কিন্তু তাহলে কেন 'দরুন' আর 'ধরন' বানানে 'ন'? এর কারণ হল ণত্ববিধি প্রযোজ্য হবে শুধুমাত্র তৎসম শব্দে। আর 'দরুন', 'ধরন' এই শব্দগুলো তৎসম শব্দ নয় তাই আমরা লিখব 'ন'। এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা বলে নিই। 'ধরণ' (ধৃ+অন) একটা সংস্কৃত শব্দ‌ও আছে। অর্থাৎ ধরে আছে যে। যে শব্দটা থেকে 'ধরণি' শব্দটা এসেছে। তবে এই অর্থে 'ধরণ' শব্দটার বাংলায় ব্যবহার প্রায় নেই বললেই চলে। শব্দটা বাংলায় 'ধর' বানিয়ে নিয়েছি। যেমন:- মুরলীধর (মুরলীধরণ), বংশীধর (বংশীধরণ)। আমরা সাধারণত বাংলায় যে 'ধরন' শব্দটা ব্যবহার করি তা একটা অতৎসম শব্দ যার মানে রকম বা প্রকার।

#বানানের_টিপস্ ( ১১ )
- স্বপন ভট্টাচার্য

স্টেশন/মাস্টার

যদি আমাদের হাতে পুরোন কোনো ব‌ই আসে তাহলে আমরা দেখব যে উপরের শব্দদুটি 'ষ্টেশন', 'মাষ্টার' এই বানানেই লেখা। আজ অবশ্য ওই বানান আর লেখার কথা নয়। কেন? কারণ বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী আমরা বিদেশি শব্দ লেখার সময় ষত্ববিধি অনুসরণ করব না। তাই আমরা লিখব স্টেশন, মাস্টার, পোস্ট, গেস্ট, ফার্স্ট, স্টার, পোস্টার, লাস্ট, স্টুডিয়ো ইত্যাদি। আমরা মনে রাখব 'কষ্ট' মানে যন্ত্রণা আর 'কস্ট' মানে মূল্য।

এখানে আর একটা কথা বলে রাখা দরকার যে শুধুমাত্র বিদেশি শব্দ ছাড়া আর সমস্ত শব্দই কিন্তু ষত্ববিধি মেনেই বানান লিখতে হবে। তাই 'কেষ্ট' তৎসম শব্দ না হলেও ষত্ববিধি মেনে 'ষ্ট' লিখতে হবে।

#বানানের_টিপস্ ( ১২ )
- স্বপন ভট্টাচার্য

কর/বল/লেখ

ক্রিয়াপদের ক্ষেত্রে বোধ হয় আমাদের সংশয় তুলনামূলকভাবে বেশি। ক্রিয়াপদের শেষে ও-কার দেওয়া সংগত কি না? বিশেষত যেখানে আমরা  ক্রিয়াপদের শেষে ও উচ্চারণ করে থাকি। 

এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির নির্দেশ /সুপারিশুলো কী সেদিকে একটু নজর দেওয়া যাক। 

নিত্যবর্তমানকালের ক্রিয়ার শেষে আমরা কখনো ও-কার ব্যবহার করব না। যেমন: 'তুমি কী কর?',  'তুমি কোন ক্লাসে পড়?' ইত্যাদি। 

আবার বর্তমান অনুজ্ঞায় তা হবে ও-কারান্ত। যেমন: 'তুমি এখন এই কাজটা করো।' 'তুমি এই ব‌ইটা পড়ো।'

তুচ্ছার্থক বর্তমান অনুজ্ঞার বিষয়ে তাদের সুপারিশ এই সব জায়গায় ক্রিয়াপদের শেষে হসন্ত ব্যবহার করতে হবে। যেমন: 'তুই কর্', 'তুই পড়্' ইত্যাদি। যদিও সাধারণভাবে আমরা এই ধরনের শব্দে হসন্ত দিই না এবং তা পড়তেও আমাদের কোনও অসুবিধা হয় না।

ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞায় শেষে ও-কার তো লাগবেই, প্রয়োজনে একাধিক ও-কার লাগাতে হবে। যেমন: 'তুমি সময়মতো এই কাজটা কোরো', 'তুমি পরে এই লেখাটা পোড়ো'।

তবে অতীত ও ভবিষ্যৎ কালে ক্রিয়াপদের শেষে আমরা ও-কার কখন‌ই ব্যবহার করব না। যেমন: করল, বলল, পড়ল, করত, বলত, পড়ত ইত্যাদি। আবার করেছিল, বলেছিল বা পড়েছিল। অথবা করব, বলব, বা পড়ব ইত্যাদি। 

অনেকে বলেন যে 'হল' বা 'হত' এই শব্দগুলো 'হলো', 'হতো' এভাবেই লেখা দরকার তা না হলে হল (hall), বা হত (মৃত) শব্দের সঙ্গে গুলিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এই মতের পিছনে কোনো যুক্তি আছে বলে মনে হয় না।  কারণ বাংলায় এই ধরনের অজস্র শব্দ আছে যেগুলো বানান আর উচ্চারণ এক হলেও আলাদা অর্থ বোঝায়। পুরো বাক্য পড়ে এবং প্রেক্ষিত বুঝেই আমরা শব্দের অর্থ নির্ণয় করি। তাই প্রশ্ন যে কত শব্দের এই রকম বানান পরিবর্তন করা হবে। 
অবশ্য বাংলা আকাদেমিও 'হল', 'হত' এভাবেই লেখার পরামর্শ দিয়েছে। 

ক্রিয়াপদের বিষয়ে আরও কিছু কথা আগামী পর্বে আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করব।

#বানানের_টিপস্ ( ১৩ )
- স্বপন ভট্টাচার্য

বলে/করে 

অসমাপিকা ক্রিয়া থাকলে স্বরসংগতির কারণে প্রথম বর্ণ ও-কারান্ত উচ্চারিত হলেও সেই বর্ণে আমরা ঊর্ধ্বকমা বা ও-কার দেব না। যেমন: আমি একটা কথা বলে তারপর আসছি। এখানে 'বলে' শব্দটাকে আমরা ব'লে, বা 'বোলে' লিখব না।

করানো, বলানো, খাওয়ানো, চালানো, বানানো এই ধরনের ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য হলে শেষে ও-কার দিতে হবে।

আবার 'জ্বালা জুড়োল', 'আমার কথাটি ফুরোল, মাঝি নৌকা ভিরোবে, কোথায় লুকোবে তুমি এইসব শব্দের দ্বিতীয় ব্যঞ্জনে আমরা ও-কার ব্যবহার করব। মনে রাখতে হবে 'ভাঙা সংসার জুড়ল' 'একটু বৃষ্টি হ‌ওয়ায় শরীরটা জুড়োল' এই দুইয়ে তফাত রাখতে হবে। কারণ 'জুড়ল' প্রযোজক ক্রিয়া না হলেও 'জুড়োল' কিন্তু প্রযোজক ক্রিয়া।

'হোন', 'হোক' এই ধরনের অনুজ্ঞাতে প্রথম ব্যঞ্জনে ও-কার দেবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 

খা, যা এই ধরনের শেষে আ-কার যুক্ত ধাতু হলে মধ্যম পুরুষের অনুজ্ঞায় আমরা লিখব, খেয়ো, যেয়ো, নিয়ো, দিয়ো ইত্যাদি। আর মধ্যম পুরুষের ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞায় অন্য ধাতু হলে করিয়ো, বলিয়ো, দেখিয়ো এভাবেই লিখব‌।

#বানানের_টিপস্ (১৪)

রকমারি ও-কারের ঝকমারি

কোনো কোনো শব্দের শেষে ও-কার দেওয়ার প্রস্তাব করেছে বাংলা আকাদেমি। সেগুলো হল: বড়ো, খাটো, ছোটো, কালো, ভালো, মতো। এছাড়াও এগারো, বারো, তেরো, চোদ্দো, পনেরো, ষোলো, সতেরো, আঠারো এই শব্দগুলোর শেষেও ও-কার দেওয়া বাঞ্ছনীয়। 

কিন্তু, এত, তত, যত, কত ইত্যাদি শব্দে ও-কার আমরা দেব না।

এটা 'কোন' [কোন্] জায়গা? এই বাক্যে 'কোন' শব্দটা প্রশ্নবাচক সর্বনাম। আবার 'তোমার যাবার 'কোনো' দরকার আছে কি? এখানে 'কোনো' শব্দটা অনিশ্চয়সূচক সর্বনাম। এই শব্দের শেষে আমরা ও-কার ব্যবহার করব। তবে এক্ষেত্রে ও-কার না লিখে ও বর্ণ‌ও লেখা যেতে পারে। অর্থাৎ 'কোনো' বা 'কোন‌ও' দুটোই লেখা চলে। আর তাই 'আরো'/আর‌ও, 'কারো'/ 'কার‌ও', 'কখনো'/ 'কখন‌ও',  'আরোই'/'আর‌ওই' এভাবেও লেখা চলবে।

আর একটা কথা ইংরেজি Too  বোঝাতে হলে কিন্তু ও-কার দিলে চলবে না। অর্থাৎ 'আজো', 'আমারো' 'রামেরো' এগুলো না লিখে 'আজ‌ও', 'আমার‌ও, 'রামের‌ও' এভাবেই লিখতে হবে। 

অত‌এব অনিশ্চয়সূচক সর্বনাম এবং ইংরেজি 'too' উভয় ক্ষেত্রেই ও-কারের বদলে 'ও' ব্যবহার করলে কোন‌ও ভুলের সম্ভাবনা থাকে না।

'লো' প্রত্যয়যুক্তশব্দের 'লো' ও-কার দিয়েই লিখতে হবে। যেমন: জোরালো, ঘোরালো, টিকোলো, প্যাঁচালো ইত্যাদি। 

'তো', 'হয়তো', 'নয়তো' এগুলোও ও-কার দিয়েই লিখতে হবে।

#বানানের_টিপস্ (১৫)

ও-কারের আরও কথা

শব্দ শেষে ও-কার বিষয়ে আরও একটা কথা বলা দরকার। আমরা 'পোটো' শব্দটা প্রায়‌ই ব্যবহার করি। শব্দটা এল কোথা থেকে? শব্দটা এসেছে পটুয়া শব্দ থেকে। ঠিক তেমনি জলুয়া থেকে 'জোলো', পড়ুয়া থেকে 'পোড়ো'। এই শব্দগুলোকে আমরা প্রথম ও শেষ এই দুই ব্যঞ্জনেই ও-কার দেব। 

এবার দেখা যাক, শব্দের মাঝে ও-কারের  কী হবে? আমরা প্রায়ই লিখে থাকি 'ইতিমধ্যে'। এই শব্দের মানে কী? শব্দটা আসলে ইতঃ+মধ্যে। মানে ইহার মধ্যে (এর মধ্যে)। যদি তাই হয় তাহলে তো বিসর্গ সন্ধির নিয়মে হয়ে যাচ্ছে 'ইতোমধ্যে'। তাই ইতোমধ্যে লেখাই বাঞ্ছনীয়। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে 'ইতিপূর্বে' শব্দটার কী হবে? শব্দটা যেহেতু ইতঃ+পূর্বে তাই আমরা ইতিপূর্বে না লিখে লিখব ইতঃপূর্বে। 

কেউ আবার হয়তো বলতে পারেন যে ইতঃ+মধ্যে যদি "ইতোমধ্যে' হয় তাহলে ইতঃ+পূর্বে 'ইতোপূর্বে' হবে না কেন? এর কারণটাও বিসর্গ সন্ধির নিয়মেই বলা আছে। যে কারণে মনঃ+রঞ্জন = মনোরঞ্জন, মনঃ+মোহন = মনোমোহন, মনঃ+গত = মনোগত, মনঃ+বাসনা = মনোবাসনা ইত্যাদি হলেও মনঃ+কষ্ট = মনঃকষ্ট, মনঃ+ ক্ষুণ্ন = মনঃক্ষুণ্ন ইত্যাদি শব্দে ও-কার না এসে বিসর্গ‌ই থেকে যাচ্ছে। কারণ এই বিসর্গের পর ক, খ, চ, ছ, ত, থ, বা প, ফ অর্থাৎ বর্গের প্রথম দুটো বর্ণ থাকলে এই বিসর্গ ও-কারে বদলে যায় না। 

তাই আমরা লিখব অকুতোভয়, ততোধিক, বয়োজ্যেষ্ঠ, মনোরোগ, মনোযোগ ইত্যাদি।
তবে মনপবন, মনমাঝি, মনমেজাজ এই শব্দগুলো  অর্ধতৎসম হ‌ওয়ায় ও-কার থাকবে না।

বিসর্গের কথা যখন উঠেই পড়ল তখন এই বিষয়ে একটা কথা এখানে বলে রাখি। শব্দ শেষে আমরা আর বিসর্গ লিখব না। অর্থাৎ প্রসঙ্গত, বস্তুত, ক্রমশ, প্রায়শ ইত্যাদি শব্দগুলো আমরা শেষে বিসর্গ না দিয়েই লিখব। 

তবে শব্দের মাঝের বিসর্গ কিন্তু থাকবে। যেমন: অতঃপর, অধঃপাত, মনঃপূত ইত্যাদি শব্দের মাঝে বিসর্গ থাকবে। তবে দুস্থ, নিস্তব্ধ, নিস্পৃহ এই শব্দগুলোতে বিসর্গ দেওয়ার দরকার নেই।

#বানানের_টিপস্ (১৬)

অত্যধিক/অত্যাচার, ব্যবস্থা/ব্যাখ্যা

উপরের  শব্দগুলোর বানান লক্ষ করে দেখুন। প্রথম শব্দে 'ত্য' থাকলেও পরের শব্দটায় কিন্তু 'ত্যা' আছে। কেন? এর কারণ হচ্ছে সন্ধির একটা নিয়ম। কী সেই নিয়ম? যদি  কোনো শব্দের শেষে ই-কার বা ঈ-কার থাকে আর পরের শব্দটা (শব্দ না হয়ে প্রত্যয়‌ও হতে পারে) কোনো স্বরবর্ণ দিয়ে শুরু হয় তবে ই বা ঈ বদলে গিয়ে য-ফলা হয়ে যায়। আর পরের স্বরবর্ণটা 'কার' চিহ্ন হয়ে ওই য-ফলার পরে বসে। (সূত্র : ই/ঈ+ ই/ঈ ছাড়া অন্য স্বর = য-ফলা+স্বর।)

উপরের দুটো শব্দ নিয়েই প্রথমে আলোচনা করা যাক। অতি+অধিক = অত্যধিক এবং অতি+আচার = অত্যাচার। প্রথম শব্দে ই-কার বদলে য-ফলা হল বটে কিন্তু তার পরে আছে 'অ'। আর 'অ'-এর কোন 'কার' চিহ্ন নেই তাই য-ফলার সঙ্গে কোনো 'কার' চিহ্ন এল না। তাই শব্দটা হয়ে গেল 'অত্যধিক'। আর দ্বিতীয় শব্দে ই-কার বদলে য-ফলা তো হল‌ই তার পরের 'আ' বর্ণটা আ-কার হয়ে য-ফলার সঙ্গে জুড়ে গেল আর শব্দটা হয়ে গেল 'অত্যাচার'। 

আর আমাদের উচ্চারণের দোষেই হোক বা অত্যাচার জাতীয় শব্দের অনুষঙ্গেই হোক আমরা অনেক সময় 'অত্যাধিক' লিখে ফেলি। তাই এখন থেকে আমরা মনে রাখব,
অতি+অন্ত = অত্যন্ত, ইতি+অবসরে = ইত‌্যবসরে, অতি+আবশ্যক = অত্যাবশ্যক, ইতি+আদি = ইত্যাদি, প্রতি+অন্ত = প্রত্যন্ত, আদি+অন্ত = আদ্যন্ত, প্রতি+আশা = প্রত্যাশা, প্রতি+আঘাত = প্রত্যাঘাত, প্রতি+এক = প্রত্যেক, প্রতি+ঊষ = প্রত্যূষ,  অনুমতি+অনুসারে= অনুমত্যনুসারে (কিন্তু, আজ্ঞা+অনুসারে= আজ্ঞানুসারে [সন্ধিসূত্র আ+অ = আ], আদেশ+অনুসারে =আদেশানুসারে [সন্ধিসূত্র অ+অ = আ])‌

আর তাই প্রতি+অর্পণ - প্রত্যর্পণ হলেও প্রতি+আবর্তন - প্রত্যাবর্তন। 

আবার বি পূর্বক শব্দগুলো নিয়েও আমাদের সমস্যার অন্ত নেই। বি+অবস্থা - ব্যবস্থা হলেও আমরা ভুল করে 'ব্যাবস্থা' লিখে ফেলি। ঠিক সেই কারণেই ব্যবহার, ব্যতিক্রম, ব্যভিচার, ব্যর্থ, ব্যয়, ব্যথা এই শব্দগুলোতে  'ব্য'। আবার ব্যাখ্যা, ব্যাপার, ব্যাকরণ, ব্যাকুল এগুলোতে 'ব্যা'।

তবে যদি 'পরি' শব্দের পর ই/ঈ ছাড়া অন্য কোনো স্বর আসে তাহলে? র-এ তো য-ফলা দেওয়া যাবে না। তখন আবার ওই 'র' হয়ে যাবে 'রেফ' আর  য-ফলা না হয়ে থাকবে শুধু 'য'। যেমন:- পরি+অন্ত = পর্যন্ত, পরি+আলোচনা = পর্যালোচনা, উপরি+উপরি = উপর্যুপরি।

তবে মনে রাখতে হবে ই, ঈ-এর পর আবার ই বা ঈ এলে কিন্তু হয়ে যাবে 'ঈ-কার'। প্রতীক্ষা, পরীক্ষা, অতীত।

#বানানের_টিপস্ (১৭)

চাই/চায়

কখন লিখব 'চাই' আর কখন লিখব 'চায়' এটা অনেক সময়ই গুলিয়ে যায়। আর দেখা যায় 'আ' অন্তক ধাতুর ক্ষেত্রেই এই সমস্যা বেশি। অর্থাৎ যা, খা, পা এগুলোতে। এ ছাড়াও গাহ্, চাহ্ এই সব ধাতু থাকলেও সমস্যা হয়। এই ধাতুগুলোর বর্তমান কালের বিভিন্ন পুরুষের রূপ দেখে নেওয়া যাক। 
আমি/আমরা     চাই (খাই, পাই, গাই ইত্যাদি)
তুমি/তোমরা       চাও
তুই/তোরা           চাস
আপনি/আপনারা চান
সে/তারা            চায়
তিনি/তাঁরা          চান

এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা বলে রাখি। 
যা ধাতু থেকে যাইতে > যেতে। 'আমি যাইতে পারিব না' অথবা চলিত ভাষায় 'আমি যেতে পারব না'। অথবা
খা > খাইতে > খেতে বা পা > পাইতে > পেতে
হলেও গাহ্, চাহ্ এইসব ধাতুর ক্ষেত্রে কিন্তু 
গাহ্ > গাহিতে > গাইতে বা চাহ্ > চাহিতে > চাইতে হবে। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়
'আমি গাহিতে পারিব না' অথবা চলিতে 'আমি গাইতে পারব না'। অর্থাৎ এই সব ধাতুর ক্ষেত্রে 'গেতে' বা 'চেতে' এরকম হবে না।

#বানানের_টিপস্ (১৮)

টি, টা, টুকু, খানি, খানা, গাছা, গাছি, গুলো, গুলি, গুলা, সমূহ, রাজি

উপরের শব্দগুলোকে বলা হয় নির্দেশক। এটাই কিন্তু নির্দেশকের পুরো তালিকা নয়। আরও অনেক আছে। আর এগুলোর মধ্যে সমূহ, রাজি এগুলো সাধারণত সাধু ভাষায় ব্যবহৃত  হয়। যেমন: গ্রন্থসমূহ, তরুরাজি। এই নির্দেশকগুলোকে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর সঙ্গে লাগালে তা সেই ব্যক্তি বা বস্তুটাকে বিশেষভাবে নির্দেশ করে। এছাড়াও এগুলো ওই ব্যক্তি বা বস্তুর সংখ্যা বা পরিমাণ‌ও নির্দেশ করে। যদি বলি, ' রাস্তায় লোক যাতায়াত করে', আর 'রাস্তাটায় লোকটা যাতায়াত করে'। প্রথম বাক্যে বোঝা যাচ্ছে যে কোন‌ও রাস্তাতেই লোক যাতায়াত করে, কিন্তু দ্বিতীয় বাক্যে একটা বিশেষ রাস্তা আর একজন বিশেষ লোকের কথা বলা হয়েছে।

আমরা অনেক সময়ই সংশয়ে পড়ে যাই যে কী লিখব 'টা' না 'টি' অথবা 'খানি' না 'খানা'? এ বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই, আপনারা যে কোনো একটা লিখতেই পারেন। তবে নির্দেশক 'টা' যোগ করলে সাধারণত কিছুটা তাচ্ছিল্য ভাব প্রকাশ পায়। আর আকাশটি, মেঘটি এইভাবে লিখলে কখনও কখনও দৃষ্টিকটু মনে হতেও পারে। 

সে যাই হোক, আজকের টিপস্ হল যে এই নির্দেশকগুলো শব্দের পরে এলে তা কিন্তু শব্দের সঙ্গে সাঁটিয়ে লিখতে হবে। অর্থাৎ লোকটি, চোরটা, ছাতাখানা, ব‌ইখানি, দুধটুকু, বাড়িগুলো ইত্যাদি লেখার সময় নির্দেশকগুলো আলাদাভাবে লিখলে চলবে না।

অবশ্য কখনও কখনও নির্দেশক আগে এলে তা আলাদা করে লেখা যেতে পারে। যেমন: খান দুই, খান আষ্টেক। তবে 'খানকতক' একসঙ্গে লেখাই বাঞ্ছনীয়।

#বানানের_টিপস্ (১৯)

বাড়ি/বাড়ী, পাখি/পাখী, কুমির/কুমীর

অনেকেই প্রশ্ন করেন যে বাড়ী, পাখী এই সমস্ত শব্দের বানান হঠাৎ করে বাড়ি, পাখি এভাবে লেখা হচ্ছে কেন? এর উত্তরে বলা যায় যে এই পরিবর্তন হঠাৎ হয়নি। আমার যতদূর মনে হয় যে রবীন্দ্রনাথ‌ই বোধ হয় এই ধরনের বানান লেখা শুরু করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বভারতীর নির্দেশ‌ও ছিল তাই।  তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সংস্কার সমিতি নির্দেশ দেয়  শব্দ অতৎসম হলে সেগুলো ই-কার বা ঈ-কার দুইভাবেই লেখা চলবে। অর্থাৎ বাড়ি অথবা বাড়ী যে কোনও একটা লিখলেই চলবে। কিন্তু বছর কুড়ি আগে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি এবং প্রায় একই সময়ে ঢাকা বাংলা একাডেমি নির্দেশ দিয়েছে যে বানানের সমতা রক্ষা করতে গেলে অতৎসম শব্দে শুধু হ্রস্বস্বর অর্থাৎ ই-কার দেওয়াই ঠিক হবে। যদিও দু-একটি শব্দে, যেমন: কাহিনি, চিন ইত্যাদি,  আকাদেমি আবার বিকল্পের সন্ধান দিয়ে রেখেছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় যে বিকল্পের সন্ধান দেওয়া মানেই বানানের সমতা রক্ষা না করার পরামর্শ। 

সে যাই হোক, এখন প্রশ্ন কোনটা তৎসম শব্দ আর কোনটা নয় তা আমরা বুঝব কীভাবে? এটা কিন্তু খুবই সমস্যার। 'রানি' শব্দটা নিয়েই আলোচনা করা যাক। এই শব্দটা কেউ যদি লেখেন 'রাণী' তাহলে আমার মনে হবে যে এটা তৎসম শব্দ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা তো নয়। 'রাজ্ঞী' তৎসম হলেও 'রানি' তৎসম শব্দ নয়। তার মানে আমাকে তৎসম শব্দ চিনতে লেখক বা কম্পোজিটার/প্রুফ রিডার এঁদের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে।

অতৎসম শব্দে স্ত্রীবাচক ঈ ব্যবহার না করে সবগুলো‌ই ই-কার দিয়েই লিখতে হবে। যেমন: কাকি, খুড়ি, খান্ডারনি, চাকরানি, ঠাকুরানি, বামনি, মাসি, পিসি, মামি, সোহাগি ইত্যাদি।

জীবিকা, ভাষা, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, জাতি এই সব শব্দে শুধু ই-কার থাকবে। যেমন: ওকালতি, জমিদারি, মোক্তারি, ডাক্তারি, আরবি, ইংরেজি, হিন্দি, মালয়ালি, কাশ্মীরি, মারাঠি, আকালি, কংগ্রেসি, ইরানি, ওড়িশি, বাঙালি ইত্যাদি।

এ ছাড়াও দেশি, বিদেশি, মরমি, মরসুমি, বন্দি, দরদি, মুলতুবি, রাজি, বাজি এগুলো‌ও ই-কার দিয়েই লিখতে হবে।

তবে মনে রাখতে হবে 'ঈয়' প্রত্যয় থাকলে কিন্তু ঈ-কার দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আর তাই আমরা লিখব ইরানীয়, অস্ট্রেলীয়, দেশীয়, এশীয়, ইউরোপীয় ইত্যাদি।

#বানানের_টিপস্ (২০)

অতৎসম শব্দে উ/ঊ

আগের পর্বে লিখেছিলাম যে অতৎসম শব্দগুলোতে আমরা শুধু ই/ই-কার ব্যবহার করব। বাংলা আকাদেমির নির্দেশ অনুযায়ী অতৎসম শব্দে 'বিকল্পহীনভাবে' হ্রস্ব উ-কার ব্যবহৃত হবে। আর তাই আমরা লিখব ধুলো, পুজো, পুরো, উনিশ, জুয়া, পুব ইত্যাদি।

এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। কোন‌ও রকম বিকল্প না রেখে একটা নিয়ম প্রবর্তনের চেষ্টা হল। কিন্তু গোলমাল হয়ে গেল তার পরেই। ঠিক তার পরেই বলা হল "দীর্ঘ উ-কার যুক্ত তৎসম শব্দ বা উপসর্গের সঙ্গে বাংলা প্রত্যয় বা শব্দ যুক্ত হলেও" মূল শব্দের দীর্ঘ ঊ/ঊ-কার বজায় রাখতে হবে। তাই লিখতে হবে ঊনত্রিশ, ধূর্তামি, মূর্খামি, পূজারি। 

বানানের নিয়ম আপনাদের জানালাম যদিও আমার নিজের খটকা যায়নি। আমার প্রশ্ন কোন‌ও তৎসম শব্দে বাংলা প্রত্যয় লাগলেও তা কি তৎসম শব্দ থেকে যায়? 'বিকল্পহীন' বানানবিধিতে আবার এই বিকল্পের সন্ধান দেওয়া কেন? উনিশ লিখলেও ঊনত্রিশ লিখতে হবে কেন? পুজুরি লিখলেও পূজারি লিখতে হবে কেন?

#বানানের_টিপস্ (২১)

দুরবস্থা/দুরাচার

একবার একজন লোক বিদ্যাসাগর মশাইকে বলেছিলেন, 'আমার খুবই "দুরাবস্থা" চলছে'‌। 'সে তোমার 'আ-কার' দেখেই বুঝতে পারছি', বিদ্যাসাগর উত্তরে বলেছিলেন। 'দুরবস্থা' শব্দে র-এ একটা আ-কার লাগিয়ে দেওয়াতেই তিনি ওই কথা বলেছিলেন। তাই আমরা লিখব দুঃ+ অবস্থা = দুরবস্থা, দুঃ+অতিক্রম = দুরতিক্রম কিন্তু দুঃ+আচার = দুরাচার, দুঃ+আত্মা = দুরাত্মা। আবার দুঃ+উক্তি = দুরুক্তি। 

আর একটা কথা দুঃ উপসর্গ দিয়ে সব শব্দের বানান কিন্তু 'দু' অর্থাৎ দ-এ হ্রস্ব উ।

#বানানের_টিপস্ (২২)

সে ভাবে/সেভাবে

'সে ভাবে' - এর অর্থ সে ভাবিতেছে বা সে ভাবছে। আর যদি লিখি 'সেভাবে' তাহলে তার অর্থ হবে 'সেই রকমে'। যদি 'ভাবে', রকম, পদ্ধতি, প্রকার এই সমস্ত বোঝায় তাহলে আমরা তা একসঙ্গে লিখব। যেমন: কীভাবে, এভাবে, সেভাবে, কোন‌ওভাবে, আন্তরিকভাবে।

#বানানের_টিপস্ (২৩)

নির্জন, নীরব

আমরা জানি যে 'নিঃ' একটা উপসর্গ।  এই উপসর্গের শেষে একটা বিসর্গ আছে। আর তাই এর পরের শব্দটার গোড়ায় যে স্বর বা ব্যঞ্জনবর্ণ থাকে তার সঙ্গে মিলে একটা বিসর্গ সন্ধি তৈরি করে। এর ফলে ওই বিসর্গ  কখনও র, রেফ্, আবার কখনও শ, ষ, বা স বর্ণে বদলে যায়। যেমন: নিঃ+অবয়ব = নিরবয়ব, নিঃ+অন্তর = নিরন্তর, নিঃ+আকার = নিরাকার, নিঃ+আশা = নিরাশা, নিঃ+উৎসাহ = নিরুৎসাহ, নিঃ+দোষ = নির্দোষ, নিঃ+ধন = নির্ধন, নিঃ+বোধ = নির্বোধ, নিঃ+নিমেষ = নির্নিমেষ, নিঃ+জন = নির্জন, নিঃ+বাক = নির্বাক, নিঃ+বান্ধব = নির্বান্ধব, নিঃ+তরঙ্গ = নিস্তরঙ্গ ইত্যাদি। আবার কখনও কখনও দেখা যাবে যে বিসর্গ যেমন ছিল তেমনি আছে। যেমন: নিঃ+সন্দেহ = নিঃসন্দেহ, নিঃ+সঙ্গ = নিঃসঙ্গ ইত্যাদি। তবে বিসর্গ বদলে যাই হোক না কেন দেখা যাবে যে সন্ধির ফলে যে শব্দটা তৈরি হল তার গোড়ায় 'নি' থেকেই যাচ্ছে।

কিন্তু এই 'নিঃ' উপসর্গের পরের শব্দের গোড়ায় যদি 'র' থাকে তাহলে কী হবে? তাহলে একটা মজার ব্যাপার ঘটে। 'নিঃ' উপসর্গের বিসর্গ তো লোপ পায়‌ই, 'নি'-এর ই-কার বদলে ঈ-কার হয়ে যায়। যেমন: নিঃ+রব  = নীরব, নিঃ+রস = নীরস, নিঃ+রোগ = নীরোগ, নিঃ+রন্ধ্র = নীরন্ধ্র, নিঃ+রক্ত = নীরক্ত ইত্যাদি। তাই আমরা খেয়াল রাখব যে 'নিঃ' উপসর্গের পর 'র' এলে আমরা লিখব ন-এ 'ঈ-কার''।

#বানানের_টিপস্ (২৪)

দায়ী/দায়ি

অনেকদিন বানানের টিপস্ লিখিনি। ইদানীং লক্ষ করেছি আমরা অনেক সময়ই 'দায়ি' বা 'দায়ী' কোনটা লিখব তা বুঝে উঠতে পারি না।
এই 'দায়ী' শব্দের একটি অর্থ দায়ক বা প্রদানকারী। যেমন: জীবনদায়ী, কষ্টদায়ী, আনন্দদায়ী ইত্যাদি। আর একটি অর্থ দায় আছে যার (দায়+ইন্)। যেমন: এই কাজের জন্য আমি দায়ী নই। প্রথম অর্থে 'দায়ী' শব্দটি ব্যবহারের সময় আমরা সাধারণত ভুল বানান লিখি না। কিন্তু আমাদের বেশি ভুল হয় দ্বিতীয় অর্থে এই শব্দের ব্যবহারে।

আমরা এই শব্দের ভুল বানান লিখি কেন? সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী 'ইন্' প্রত্যয় যোগ হলে অ-কারান্ত শব্দের শেষে দীর্ঘ ঈ হয়। যেমন: মান+ইন্ = মানী, জ্ঞান+ইন্ = জ্ঞানী, দায়+ইন্ = দায়ী ইত্যাদি। কিন্তু এই শব্দের সঙ্গে 'ত্ব' এবং আরও কয়েকটি প্রত্যয় যোগ হলে শব্দশেষের দীর্ঘ ঈ, হ্রস্ব ই হয়ে যায়। যেমন: মন্ত্রী+ত্ব = মন্ত্রিত্ব, ঠিক তেমনি দায়ী+ত্ব = দায়িত্ব। আর এই শব্দটা আমাদের মাথায় থাকে বলেই আমরা লিখে ফেলি 'দায়ি'। আবার এর উল্টোটাও হয়। দায়ী শব্দের সঙ্গে 'ত্ব' জুড়ে আমরা অনেক সময় 'দায়ীত্ব' লিখে ফেলি। 

এছাড়াও মনে রাখতে হবে যে দায়ক অর্থে দায়ী শব্দকে স্ত্রীলিঙ্গ করলে হয়ে যাবে দায়িনী। যেমন: আনন্দদায়ী থেকে আনন্দদায়িনী।

সুতরাং আমরা লিখব 'দায়ী', 'দায়িত্ব', 'জীবনদায়ী', 'জীবনদায়িনী'‌।

#বানানের_টিপস্ (২৫)

পড়া/পরা

পড়া না পরা? এ নিয়ে সংশয়ের শেষ নেই। যেখানে 'পরা' লেখা উচিত অনেক সময়ই তা হয়ে যায় 'পড়া'। আবার উল্টোটাও হয়। 

একটা সহজ নিয়ম ঠিক করে নেওয়া যেতে পারে। যখন 'পরা' অর্থ পরিধান করা বা অঙ্গে ধারণ করা তখন আমরা লিখব 'পরা'। যেমন: জামা পরা, জুতো পরা, মাদুলি পরা, টিপ পরা, সিঁদুর পরা, পৈতে পরা, চশমা পরা ইত্যাদি।

এছাড়া আর সব হল 'পড়া'। যেমন: ব‌ই পড়া, গাছ থেকে পড়া, পিছিয়ে পড়া, রক্ত পড়া, বাকি পড়া (অনেক টাকা বাকি পড়ে আছে), অব্যবহৃত (বাড়িটা খালি পড়ে আছে), ডাকাত পড়া, শীত পড়া (এ বছর খুব শীত পড়েছে), ধরা পড়া, দান পড়া (লুডো খেলায় বড়ো বড়ো দান পড়ছে), বিপদে পড়া, ফাঁকিতে পড়া (এখন ফাঁকি দিচ্ছ পরে নিজেই ফাঁকিতে পড়বে),  গায়ে পড়া, খুব মুশকিলে পড়েছি, ছেলেটা পা পিছলে পড়েছে, আমি একটু আগেই শুয়ে পড়েছি, অনেক কাজ পড়ে আছে, বড়ো বেশি কাজ পড়ে গেছে, বেলা যে পড়ে এল, জালে মাছ পড়েছে, মনে পড়েছে, রোগে পড়া (তুমি তো প্রায়ই রোগে পড়),  কত খরচ পড়বে, এবার রাগ পড়েছে, তেজ পড়তে শুরু করেছে, চোখে পড়া ( ওই শাড়িটা চোখে পড়েছে), (চোখে ধুলো পড়েছে),  পেটে ভাত পড়েছে, তাদের অবস্থা এখন পড়ে গেছে, একবার বাজার উঠলে তা আর পড়ে না, তার পাল্লায় পড়লে তখন বুঝবে, নদী সাগরে পড়েছে, পাউরুটিতে ছাতা পড়েছে, পড়ে পাওয়া, পাখি পড়া, জল পড়া, কেটে পড়া, প্রেমে পড়া এ সবই 'পড়া'।

আর‌ও একটা আছে। ব‌ইটা 'পড়ে' আর একটা জামা 'পরে' একটু 'পরে' এস।

#বানানের_টিপস্ (২৬)

উপর/ওপর

প্রায়ই একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, 'উপর' না 'ওপর' কোনটা লেখা সমীচীন? অনেকে মনে করেন যে 'উপর' শব্দটা বোধ হয় তৎসম অর্থাৎ সংস্কৃত শব্দ। তা কিন্তু নয়। সংস্কৃত শব্দ 'উপরি' থেকে এসেছে 'উপর' > 'ওপর' শব্দ। 'উপর' শব্দের কথ্য রূপ 'ওপর'। আর এই দুটোর কোনোটাই ভুল নয়। যে কোন‌ও একটা লেখা যেতে পারে। তবে অনেকে একটু গম্ভীর চালে লিখলে 'উপর' আর হালকা চালে লিখলে 'ওপর' লেখা পছন্দ করেন।

এই 'উপর'/'ওপর' শব্দের কিন্তু অনেক অর্থ হয়। যেমন কেউ বলতে পারেন যে 'এই লেখাটা মাথার উপর/ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল।' এখানে উপর/ওপর মানে ঊর্দ্ধ। কিন্তু যদি বলি, 'একে জ্বর তার উপর/ওপর পেট খারাপ'। এখানে শব্দটার মানে অতিরিক্ত। রাজারা মানুষের উপর/ওপর 
অত্যাচার করত‌ (প্রতি)।  উপর‌ওয়ালার কথা শুনে চলতেই হবে (ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ)। সে উপরপড়া হয়ে অনেক কথা শুনিয়ে গেল (অযাচিতভাবে)। উপরচালাকি  না করাই ভালো (অতিরিক্ত চালাকি)। এছাড়াও উপরচড়াও, উপর‌উপর, উপরচাল এই সব শব্দে‌ও এই শব্দটির ব্যবহার আছে।

#বানানের_টিপস্ (২৭)

‌দরিদ্র, দারিদ্র্য
দরিদ্র শব্দটা বিশেষণ। এই শব্দের সঙ্গে ষ্ণ্য (য) অথবা 'তা' যোগ করে একে বিশেষ্য শব্দে পরিণত করা হয়। যেমন: দরিদ্র+য = দারিদ্র্য, দরিদ্র+তা = দরিদ্রতা। আমরা অনেক সময়ই ভুল করে এই দুটি প্রত্যয়‌ই এক‌ই সঙ্গে লাগিয়ে দিই, লিখে ফেলি 'দারিদ্র্যতা'। এই শব্দের কিন্তু কোন‌ও অর্থ নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে কোন‌ও শব্দে  একই অর্থে দুটো প্রত্যয় লাগানো যায় না। আমরা হয় লিখব 'দারিদ্র্য' অথবা লিখব 'দরিদ্রতা'। 

ঠিক সেভাবেই স্বাতন্ত্র্য বা স্বতন্ত্রতা, সারল্য বা সরলতা, দৌর্বল্য বা দুর্বলতা, ঔদার্য বা উদারতা, বৈশিষ্ট্য বা বিশিষ্টতা, নৈপুণ্য বা নিপুণতা ইত্যাদি শব্দ লিখলে যে কোন‌ও একটা লিখব।

বানানের_টিপস্ (২৮)

‌প্রতিযোগী>প্রতিযোগিতা >প্রতিযোগিনী, 

'প্রতিযোগ' শব্দের অর্থ বিরোধ। এটি একটি বিশেষ্য পদ। এই শব্দটির সঙ্গে 'ঈ' যোগ করে এই শব্দটিকে বিশেষণে পরিণত করা হয়। 'প্রতিযোগী' শব্দের মানে প্রতিদ্বন্দ্বী। এই শব্দে 'তা' যোগ করে আবার এটিকে বিশেষ্য পদে পরিণত করা যায়। আর এই ক্ষেত্রে 'প্রতিযোগী' শব্দের শেষের 'ঈ' বদলে 'ই' হয়ে যায়। প্রতিযোগী+তা = প্রতিযোগিতা। কিন্তু আমরা অনেক সময়ই ভুল করে 'প্রতিযোগীতা' লিখে ফেলি।

ঠিক এভাবেই সহযোগী > সহযোগিতা, প্রত্যুপকারী > প্রত্যুপকারিতা, সহমর্মী > সহমর্মিতা ইত্যাদি। 
পআবার এই শব্দগুলো স্ত্রীলিঙ্গে হবে সহযোগিনী, প্রতিযোগিনী, প্রত্যুপকারিণী ইত্যাদি।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ক্লিক করলেই ইনকাম