দারিদ্র্যরেখা
তারাপদ রায়আমি নিতান্ত গরীব ছিলাম, খুবই গরীব।
আমার ক্ষুধার অন্ন ছিল না,
আমার লজ্জা নিবারণের কাপড় ছিলো না।
আমার মাথার উপরে আচ্ছাদন ছিলো না।
অসীম দয়ার শরীর আপনার
আপনি এসে আমাকে বললেন,
‘না, গরীব কথাটা খুব খারাপ,
ওতে মানুষের মর্যাদাহানি হয়,
তুমি আসলে দরিদ্র।’
অপরিসীম দারিদ্র্যের মধ্যে আমার কষ্টের দিন,
আমার কষ্টের দিন, দিনের পর দিন আর শেষ হয় না,
আমি আরো জীর্ণ আরো ক্লীষ্ট হয়ে গেলাম,
হঠাৎ আপনি আবার এলেন, এসে বললেন,
‘দ্যাখো, বিবেচনা করে দেখলাম
দারিদ্র্য শব্দটাও ভালো নয়; তুমি হলে নিঃস্ব।’
দীর্ঘ নিঃস্বতায় আমার দিনরাত্রি;
গনগনে গরমে ধুঁকতে ধুঁকতে,
শীতের রাতের ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে
বর্ষার জলে ভিজতে ভিজতে
আমি নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে গেলাম।
আপনার কিন্তু ক্লান্তি নেই,
আপনি আবার এলেন, আপনি বললেন,
‘তোমার নিঃস্বতার কোন মানে হয় না।
তুমি নিঃস্ব হবে কেন,
তোমাকে চিরকাল শুধু বঞ্চনা করা হয়েছে,
তুমি বঞ্চিত, তুমি চির বঞ্চিত।’
আমার বঞ্চনার অবসান নেই,
বছরের পর বছর আধপেটা খেয়ে,
উদোম আকাশের নিচে রাস্তায় শুয়ে,
কঙ্কালসার হয়ে আমার বেঁচে থাকা।
কিন্তু আপনি আমাকে ভোলেন নি,
এবার আপনার মুষ্টিবদ্ধ হাত,
আপনি এসে উদাত্ত কণ্ঠে ডাক দিলেন,
‘জাগো, জাগো সর্বহারা।’
তখন আর আমার জাগবার ক্ষমতা নেই,
ক্ষুধায় অনাহারে আমি শেষ হয়ে এসেছি,
আমার বুকের পাঁজর হাপরের মত ওঠা-নামা করছে,
আপনার উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে
আমি তালই মেলাতে পারছি না।
ইতিমধ্যে আরো বহুদিন গিয়েছে,
আপনি এখন আরো বুদ্ধিমান,
আরো চৌকস হয়েছেন।
এবার আপনি একটি ব্ল্যাক-বোর্ড নিয়ে এসেছেন,
সেখানে চকখড়ি দিয়ে যতœ করে
একটি ঝকঝকে লম্বা লাইন টেনে দিয়েছেন;
এবার বড় পরিশ্রম হয়েছে আপনার,
কপালের ঘাম মুছে আমাকে বলছেন,
এই যে রেখা দেখছ, এর নিচে,
অনেক নিচে তুমি রয়েছো!’
চমৎকার!
আপনাকে ধন্যবাদ, বহু ধন্যবাদ!
আমার গরীবপনার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আমার দারিদ্র্যের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আমার নিঃস্বতার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আমার বঞ্চনার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আমার সর্বহারাত্বের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আর সবশেষে ঐ ঝকঝকে লম্বা রেখাটি,
ঐ উজ্জ্বল উপহারটির জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।
কিন্তু, ক্রমশÑ
আমার ক্ষুধার অন্ন এখন আরো কমে গেছে,
আমার লজ্জা নিবারণের কাপড় এখন আরো ছিঁড়ে গেছে,
আমার মাথার উপরের আচ্ছাদন আরো সরে গেছে।
কিন্তু ধন্যবাদ,
হে প্রগাঢ় হিতৈষী, আপনাকে ধন্যবাদ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন