মঙ্গলবার, ১০ জুন, ২০১৪

বন্দীর বন্দনা

বন্দীর বন্দনা
বুদ্ধদেব বসু

বুদ্ধদেব বসু

প্রবৃত্তির অবিচ্ছেদ্য কারাগারে চিরন্তন বন্দী করি’ রচেছো আমায়-
নির্মম নির্মাতা মম! এ কেবল অকারণ আনন্দ তোমার!
মনে করি, মুক্ত হবো; মনে ভাবি, রহিতে দিবো না
মোর তরে এ-নিখিলে বন্ধনের চিহ্নমাত্র আর।
রুক্ষ দস্যুবেশে তাই হাস্যমুখে ভেসে যাই উচ্ছ্বসিত স্বেচ্ছাচার-স্রোতে,
উপেক্ষিয়া চ’লে যাই সংসার-সমাজ-গড়া লক্ষ-লক্ষ ক্ষুদ্র কন্টকের
নিষ্ঠুর আঘাত; দাসত্বের স্নেহের সন্তান
সংস্কারের বুকে হানি তীব্র তীক্ষè রূঢ় পরিহাস,
অবজ্ঞার কঠোর ভর্ৎসনা।
মনে ভাবি, মুক্তি বুঝি কাছে এল-
বিশ্বের আকাশে বহে লাবণ্যের মৃত্যুহীন স্রোত।


তারপরে একদিন অকস্মাৎ বিস্ময়ে নেহারি-
কোথা মুক্তি?
সহস্র অদৃশ্য বাধা নিশিদিন ঘিরে আছে মোরে,
যতই এড়ায়ে চলি, ততই জড়ায়ে ধরে পায়ে,
রোধ করে জীবনের গতি।
সে-বন্ধন চলে মোর সাথে-সাথে জীবনের নিত্য অভিসারে
সুন্দরের মন্দিরের পানে।
সে-বন্ধন মগ্ন করি’ রেখেছে আমারে
আকন্ঠ পঙ্কের মাঝে।
সে-বন্ধন লক্ষ-লক্ষ লাঞ্ছনার বীজাণুতে
কলুষিত করিয়াছে নিশ্বাসের বাতাস আমার-
লোহিত শোণিত মম নীল হ’য়ে গেছে সে-বন্ধনে।
ক্ষণ-তরে নাহি মুক্তি; কর্ম-মাঝে, মর্ম-মাঝে মোর,
প্রতি স্বপ্নে, প্রতি জাগরণে,
প্রতি দিবসের লক্ষ বাসনা-আশায়
আমারে রেখেছো বেঁধে অভিশপ্ত, তপ্ত নাগপাশে
সৃজন-উষার আদি হ’তে-
উদাসীন স্রষ্টা মোর!
মুক্তি শুধু মরীচিকা-সুমধুর মিথ্যার স্বপন,
আপনার কাছে মোরে করিয়াছো বন্দী চিরন্তন।

বাসনার বক্ষোমাঝে কেঁদে মরে ক্ষুদিত যৌবন,
দুর্দম বেদনা তার স্ফুটনের আগ্রহে অধীর।
রক্তের আরক্ত লাজে লক্ষবর্ষ-উপবাসী শৃঙ্গারকামনা
রমণীরমণ-রণে পরাজয়-ভিক্ষা মাগে নিতি;-
তাদের মেটাতে হয় বঞ্চনার দুর্দম বিক্ষোভ।
আছে ক্রূর স্বার্থদৃষ্টি, আছে মূঢ় ক্লেদলিপ্ত লোভ,
হিরণ্ময় প্রেমপাত্রে হীন হিংসা-সর্প গুপ্ত আছে।
আনন্দনন্দিত দেহে কামনার কুৎসিত দংশন,
জিঘাংসার কুটিল কুশ্রীতা।
সুন্দরের ধ্যান মোর এরা সব ক্ষণে-ক্ষণে ভেঙে দিয়ে যায়,
কাঁদায় আমারে সদা অপমানে, ব্যথায়, লজ্জায়।
ভুলিয়া থকিতে চাই;- ক্ষণ-তরে ভুলে যাই ডুবে গিয়ে লাবণ্য-উচ্ছ্বাসে-
তবু, হায়, পারি না ভুলিতে।
নিমিষে-নিমিষে ত্রুটি, পদে-পদে স্খলন-পতন,
আপনারে ভুলে যাওয়া-সুন্দরের নিত্য অসম্মান।
বিশ্ব¯্রষ্টা, তুমি মোরে গড়েছো অক্ষম করি’ যদি
মোরে ক্ষমা করি’ তব অপরাধ করিয়ো ক্ষালন।

জ্যোতির্ময়, আজি মম জ্যোর্তিহীন বন্দীশালা  হ’তে
বন্দনাসংগীত গাহিব তব।
স্বর্গলোভ নাহি মোর, নাহি মোর পুণ্যের সঞ্চয়,
লাঞ্ছিত বাসনা দিয়া অর্ঘ্য তব রচি আমি আজি:
শাশ্বত সংগ্রামে মোর আহত বক্ষের যত রক্তাক্ত ক্ষতের বীভৎসতা,
হে চিরসুন্দর, মোর নমস্কার-সহ লহো আজি।

বিধাতা, জানো না তুমি কী অপার পিপাসা আমার
অমৃতের তরে।
না-হয় ডুবিয়া আছি কৃমিঘন পঙ্কের সাগরে,
গোপন অন্তর মম নিরন্তর সুধার তৃষ্ণায়
শুষ্ক হ’য়ে আছে তবু।
না-হয় রেখেছো বেঁধে; তবু জেনো, শৃক্সক্ষলিত ক্ষুদ্র হস্ত মোর
উধাও আগ্রহভরে উর্ধ্বনভে উঠিবারে চায়
অসীমের নীলিমারে জড়াইতে ব্যগ্র আলিঙ্গনে।
মোর আঁখি রহে জাগি’ নিস্তব্ধ নিশীথে,
আপন আসনপাতে নিদ্রাহীন নক্ষত্রসভায় ,
স্বচ্ছ শুক্ল ছায়াপথে মায়ারথে ভ্রমি’ ফেরে কভু
আবেশ-বিভ্রমে।
তুমি মোরে দিয়েছো কামনা, অন্ধকার অমারাত্রি-সম,
তাহে আমি গড়িয়াছি প্রেম, মিলাইয়া স্বপ্নসুধা মম।
তাই মোর দেহ যবে ভিক্ষুকের মতো ঘুরে মরে
ক্ষুধাজীর্ণ, বিশীর্ণ কঙ্কাল-
সমস্ত অন্তর মম সে-মুহূর্তে গেয়ে ওঠে গান
অনন্তের চির-বার্তা নিয়া;
সে কেবল বার-বার অসীমের কানে-কানে একটি গোপন বাণী কহে-
‘তবু আমি ভালোবাসি, তবু আমি ভালোবাসি আজি!’

রক্তমাঝে মদ্যফেনা, সেথা মীনকেতনের উড়িছে কেতন,
শিরায়-শিরায় শত সরীসৃপ তোলে শিহরণ,
লোলুপ লালসা করে অন্যমনে রসনালেহন।
তবু আমি অমৃতাভীলাষী!-
অমৃতের অন্বেষণে ভালোবাসি, শুধু ভালোবাসি,
ভালোবাসি-আর-কিছু নয়।
তুমি যারে সৃজিয়াছো, ওগো শিল্পী, সে তো নহি আমি,
সে তোমার দুঃস্বপ্ন দারুণ।
বিশ্বের মাধুর্য-রস তিলে-তিলে করিয়া চয়ন
আমারে রচেছি আমি;- তুমি কোথা ছিলে অচেতন
সে-মহাসৃজন-কালে- তুমি শুধু জানো সেই কথা।

মোর আপনারে আমি নবজন্ম করিয়াছি দান।
নিখিলের স্রষ্টা তুমি, তোমার উদ্দেশে আজি তাই,
মোর এই সৃষ্টিকার্য উৎকৃষ্ট করিনু সন্তর্পণে।
মোর এই নব সৃষ্টি- এ যে মূর্ত বন্দনা তোমার,
অনাদির মিলিত সংগীত।
আমি কবি, এ-সংগীত রচিয়াছি উদ্দীপ্ত উল্লাসে,
এই গর্ব মোর-
তোমার ত্রুটিরে আমি আপন সাধনা দিয়া করেছি শোধন,
এই গর্ব মোর।
লাঞ্ছিত এ-বন্দী তাই বন্ধহীন আনন্দ-উচ্ছ্বাসে
বন্দনার ছদ্মনামে নিষ্ঠুর বিদ্রুপ গেলো হানি’
        তোমার সকাশে।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ক্লিক করলেই ইনকাম