প্রত্যাবর্তনের আনন্দ
__নির্মলেন্দু গুণ
পাক-কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে
যেদিন আমি আমার প্রিয় মাতৃভুমির
মুক্ত-মাটিতে পা রেখেছিলাম; ওটাই
ছিল আমার সবচেয়ে আনন্দের দিন।
আমার কাছে, স্বর্গপ্রবেশতুল্য
মাহেন্দ্র মুহুর্ত ছিল তা।
লন্ডন ও দিল্লির আকাশ পাড়ি দিয়ে
বাংলাদেশের নীলিমায় প্রবেশ করেই
আমি স্মরণ করেছিলাম আমার স্রষ্টাকে,
আমার মাতৃভুমির মুক্তির সংগ্রামে
নেতৃত্ব দেবার জন্য যিনি আমাকে
বিশেষভাবে সৃষ্টি করেছিলেন।
আমাকে বরণ করার জন্য অপেক্ষমাণ
জনতার স্রোত প্রবহমান নদীর মতন
আমাকে সেদিন ভাসিয়ে নিয়েছিল
সেই চিরসবুজ স্বপ্নের উদ্যানে−,
যেখানে দাঁড়িয়ে আমার দেশবাসীকে
আমি স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম স্বাধীনতার।
আমাকে একটুখানি দেখার আশায়
স্বাধীনতার ঐ সবুজ উদ্যানে তখন
অপেক্ষা করছিল গোটা বাংলাদেশ।
যার কণ্ঠ থেকে সর্বদা বর্ষিত হতো বজ্র,
প্রস্ফুটিত হতো শব্দের অগ্নিকুসুম,
সেই দ্বিপ্রহরে বজ্র এবং অগ্নির বদলে
তার চোখ থেকে ঝ'রে পড়েছিল অশ্রু;
বজ্রকন্ঠ থেকে স্বপ্নপূরণের কান্না।
বিজয়ের আনন্দে আমি বলেছিলাম−
কবিগুরু, দেখে যান−আপনার কবিতা
আজ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে−
আমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।
আনন্দের ঘোর কাটতে না কাটতেই,
একাত্তরের পরাজিত এজিদবাহিনী
রাত্রির অন্ধকারে সংগঠিত হয়ে
পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট
সপরিবারে হত্যা করল আমাকে।
ওরা কারাগারের ভিতরে প্রবেশ করে
হত্যা করল চার জাতীয় নেতাকে;
আমার কারাবাসকালে
যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
ওরা আমাদের রক্তলব্ধ সংবিধানকে
পিষ্ট করল সামরিক বুটের তলায়।
ওরা ইতিহাসকে করল বিকৃত।
আবহমান বাঙালির হৃদ্যরক্তস্রোতে
ওরা বপন করল বিষবৃক্ষের বীজ।
ওরা জানত না, মিথ্যার মেঘ দিয়ে
ঢাকা যায় না সত্যের সুর্য চিরদিন।
ওরা জানত না, এই মৌন উদাসীন
প্রকৃতিও বিকৃতিকে সমর্থন করে না।
সর্বস্ব হারিয়েও আমি বিশ্বাস করেছি−
বাঙালিকে অবিশ্বাস করা পাপ।
বিলম্বে হলেও, ওদের চক্রান্ত তাই
ব্যর্থ হয়েছে,
ব্যর্থ হয়েছে,
ব্যর্থ হয়েছে।
বুলেটের চেয়ে বড় ব্যালট-বিপ্লবে
আজ বিজয়ী হয়েছে আমার মানুষ।
আজ আমি অনুভব করছি সেই আনন্দ,
যা আমি অনুভব করেছিলাম
আমার প্রথম স্বদেশ-প্রত্যাবর্তনের দিন।
মৃত্যুকে পশ্চাতে ফেলে, মৃত্যুঞ্জয় হয়ে
আজ আমি পুনর্বার ফিরে এসেছি
আমার প্রিয় স্বদেশের শুদ্ধ নীলিমায়।
বৃক্ষ হয়ে, ফুল হয়ে, প্রজাপতি হয়ে
আমি প্রদক্ষিণ করব এই দেশকে।
কিশোরীর আদরের রাজহাঁস হয়ে
আমি ভেসে বেড়াব জলাঙ্গির জলে।
রবিশস্য হব হেমন্তের ঘন কুয়াশায়।
বহুদিন পর আজ সত্য জয়ী হয়েছে−,
সংগ্রাম জয়ী হয়েছে, সুন্দর জয়ী হয়েছে।
আজ আমার খুব আনন্দের দিন।
১০ জানুয়ারি ২০০৯
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন