শনিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২০

যে শহরে আমি নেই আমি থাকব না | আবিদ আজাদ



যে শহরে আমি নেই আমি থাকব না 
__আবিদ আজাদ

যে শহরে আমি নেই আমি থাকব না সে শহরে যুদ্ধ শেষের ভাঙা পোড়া একটা এয়ারপোর্টের মতো বেঁচে থাকবে তুমি
তোমাকে ঘিরে সারা ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে স্কার্টপরা বুড়ি বার্মিজ মহিলার মতো ভৌতিক নির্জনতা
তোমাকে ঘিরে সারা ক্ষণ ঝুলে থাকবে তছনছ তারের জটিলতা
লতাগুল্মময় ক্রেনের কঙ্কাল, জংপড়া লোহালক্কড় আর হিংস্র ঘাসের মধ্যে ধু–ধু করবে তোমার জীবন
ভয়ার্ত সব মিলিটারি ভ্যান আর উল্টে থাকা ট্রলির পাশে ক্ষত–বিক্ষত একটা চাঁদ ওঠা রানওয়ের মতো
তুমি মুখ লুকিয়ে রাখবে গা–ছমছম করা জ্যোৎস্নায়।
যে শহরে আমি নেই আমি থাকব না সে শহরে জনহীন কোনো পেট্রোল পাম্পের দেয়াল ঘেঁষে একটা মরা শিউলি গাছের মতো বেঁচে থাকবে তুমি –
তোমাকে ঘিরে হা–হা করবে নিদাঘরাত
দেখবে পর্যুদস্ত একটা হেলমেটের ফাটল দিয়ে মাথা তুলছে একগুচ্ছ সবুজ তৃণ
শুনবে ধ্বংসস্তুপের মধ্যে অর্ধডোবা সূর্যাস্তের মতো আগুন লাগা বিলুপ্তপ্রায় লাউঞ্জ থেকে ভেসে আসছে প্রেতহাসির শব্দ
আর তোমাকে ঘিরে নামবে এক জোড়া জনশূণ্য বুটের স্তব্ধতা।
যে শহরে আমি নেই থাকব না সে শহরে প্রতিদিন দুর্ঘটনা দিয়ে শুরু হবে তোমার ভোর
সকাল সাতটা থেকেই অনবরত টেলিফোনে আসতে থাকবে সানস্ট্রোকের সংবাদ
তোমার পাশের সাততলা জানালা থেকে লাফিয়ে পড়বে কোঁকড়াচুলের যুবক
একদিন গলায় ক্ষুর চালাতে–চালাতে ঘুমিয়ে পড়বেন সেই বুড়ো
সবুজ রঙের গলাবন্ধ পরে চকচকে বেতের স্টিক হাতে যিনি মনিংওয়াকে বেরুতেন রোজ
একটি কিশোরী তার আব্বার রেজর থেকে লুকিয়ে খুলে নেবে ব্লেড
গভীর জ্যোৎস্নাঙ্কিত স্ট্রিটের মাথায় হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়বে কালো রঙের গাড়ি
একজন মানুষ শিরীষ গাছের ভিতরে টিপে ধরবে আর একজন মানুষের গলা
পার্কের ঝরাপাতার উপর সারা রাত ধরে শিশিরে ভিজে যাবে মৃত তরুণীর হাঁটুর ভাঁজ
যে শহরে আমি নেই আমি থাকব না সে শহরে চরম দুর্বোধ্যতম হয়ে বেড়ে উঠবে তোমার বিষণ্ণ সন্তান
বারবার করে বদলাতে হবে তার ঝাপসা চোখের চশমার গ্লাস
তুমি তাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে ভোরের ইস্কুলে
কিন্তু কাঁধে ব্যাগ নিয়ে আর কোনোদিন ফিরে আসবে না নীল হাফপ্যান্টপরা তোমার ছেলে, আসবে না
তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে ইস্কুল–বাড়ির সামনে :  রাস্তার ওপারে –
যে শহরে আমি নেই আমি থাকব না সে শহরে নিয়মিত দুধের বোতল দিয়ে যাবে ডেইরি ফার্মের গাড়ি
কিন্তু সেই দুধে মেশানো থাকবে গুঁড়োবিষ
তোমার ফ্রিজের ভিতরে মরে পড়ে থাকবে সাদা ইঁদুর
তোমার ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় বসে থাকবে একটা তেলাপোকা তার রং হবে মারাত্মক রকম লাল
তোমার ওয়ারড্রোবের ভিতর থেকে হ্যাঙ্গার শুদ্ধ ঝাঁপিয়ে পড়বে মধ্যরাতের কাপড়চোপড়
তুমি পালাতে চাইবে পালাতে চাইবে
ছুটে পালাবে
ছুটবে
ছুটতে ছুটতে তুমি তিনতলার জানলার একখন্ড পরদার মতো আটকে যাবে বারবার
তুমি ঊধ্বশ্বাসে ছুটে পালাবে ঘুমের ভিতর
কিন্তু মৃত শহর শাণিত করে রাখবে তার সমস্ত রাস্তার বালি
তারার ভিতর থেকে সারা রাত ধরে খসে পড়বে চুন
হঠাৎ লক্ষ–লক্ষ হাতের করতালি বেজে উঠবে আতঙ্কিত মোড়ে–মোড়ে
দেখবে সাদা ট্রাফিক দাঁড়িয়ে আছে বাজপড়া তালগাছের মতো
তার হাত দুটো ঝুলছে চাঁদহীন মরা ডালের মতো
চোখের লোমহর্ষক দুটো গর্তের ভিতর দিয়ে চলেছে বিষাক্ত পিঁপড়ের বাহিনী
তার মাথার ফাটলে গজিয়েছে একটা বটচারা
তোমার ভয়ার্ত চিৎকারে শুধু সেই মৃত ট্রাফিকের লাল
হা–এর ভিতর থেকে উড়ে যাবে একটা সন্ত্রস্থ বনটিয়া।
যে শহরে আমি নেই আমি থাকব না সে শহরে লিফট তোমাকে নিয়ে সোজা নেমে যাবে পাতালে
তোমাকে নিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো পার্কের ধারের খাদে ছিটকে পড়বে বাস
লেকের হাঁসগুলি গুগলির মতো ঠুকরে খাবে মানুষের চোখ
আর খুব বিকেলবেলায় তুমি ক্লান্ত হয়ে
ক্লান্ত হয়ে
ক্লান্ত হয়ে
ফিরবে ঘরে
কিন্তু তোমার ঘরের নিঃসঙ্গ দরোজা তোমাকে খুলে দেবে হুহু শীতার্ত প্রান্তর
তোমার সোফা তোমাকে বসতে দেবে না পাঠিয়ে দেবে বেডরুমের বিছানায়
তুমি বাথরুমে যাবে, শাওয়ার খুলে দিলে ঝরবে রক্ত তুমি বেসিনে নুয়ে পড়বে, পানির ঝাপটা দিতেই মনে হবে
কার গলা যেন কাশতে–কাশতে পাঠিয়ে দিচ্ছে যক্ষার ফুল
তুমি ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে,
দেখবে বীভৎস একটা চিড় ধরে আছে আয়নায়।
সেই চিড়–ধরা আয়নার ভিতরে তারপর ক্রমশ হারিয়ে যাবে তোমার আর্তনাদ
আর তোমার মনে হবে, আমি নেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ক্লিক করলেই ইনকাম