মেজাজ
সুভাষ মুখোপাধ্যায় |
থলির ভেতর হাত ঢেকে
শাশুড়ি বিড়বিড় ক’রে মালা জপছেন;
বউ
গটগট ক’রে হেঁটে গেল।
আওয়াজটা বেয়াড়া; রোজকার আটপৌরে নয়।
যেন বাড়িতে ফেরিঅলা ডেকে
শখ ক’রে নতুন কেনা হয়েছে।
সুতরাং
মালাটা থেমে গেল; এবং
চোখ দুটো বিষ হয়ে
ঘাড়টাকে হেলিয়ে দিয়ে যেদিকে বউ যাচ্ছিলো
সেইদিকে ঢ’লে পড়লো।
নিচের চোয়ালটা সামনে ঠেলে
দাঁতে দাঁতে লাগলো।
বিলক্ষণ রাগ দেখিয়ে
পরমুহূর্তেই শাশুড়ির দাঁত চোখ ঘাড় চোয়াল
যে যার জায়গায় ফিরে এলা।
তারপর সারা বাড়িটাকে আঁচ্ড়ে আঁচ্ড়ে
কলতলায়
ঝমর ঝম খনর খন ক্যাঁচ ঘ্যাঁষঘিঁষ ক্যাঁচর ক্যাঁচর
শব্দ উঠলো।
বাসনগুলো কোনোদিন তো এত ঝাঁঝ দেখায় না-
বড় তেল হয়েছে।
ঘুরতে ঘুরতে মালাটা দাঁড়িয়ে পড়ল।
নোড়া দিয়ে মুখ ভেঙে দিতে হয়-
মালাটা একবার ঝাঁকুনি খেয়ে
আবার চলতে লাগল।
নাকে অস্ফুট শব্দ ক’রে
থলির ভেতর পাঁচটা আঙুল হঠাৎ
মালাটার গলা টিপে ধরল।
মিন্সের আক্কেলও বলিহারি!
কোত্থেকে এক কালো অলক্ষুণে
পায়ে খুরঅলা ধিঙ্গি মেয়ে ধ’রে এনে
ছেলেটার গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে চলে গেলো।
কেন? বাংলাদেশে ফরসা মেয়ে ছিল না?
বাপ অবশ্য দিয়েছিল থুয়েছিল-
হ্যাঁ, দিয়েছিল!
গলায় রসুড়ি দিয়ে আদায় করা হয়েছিল না?
এবার মালাটাকে দয়া ক’রে ছেড়ে দেওয়া হল।
শাশুড়ির মুখ দেখে মনে হচ্ছিলো
থলির ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে এই সময়ে
কী যেন তিনি লুকোচ্ছিলেন।
একটা জিনিস-
ক’মাস আগে বউমা-
মরবার জন্য বিষ খেয়েছিলো।
ভাসুরপো ডাক্তার না হলে
ও-বউ এ-বংশের গালে ঠিক চুনকালি মাখাতো।
কেন? অসুখ ক’রে মরলে কী হয়?
ঢঙী আর বলেছে কাকে!
হাতে একরাশ ময়লা কাপড় নিয়ে
কালো বউ
গটগট গটগট ক’রে সামনে দিয়ে চলে গেল।
নাঃ, আর বাড়তে দেয়া ঠিক নয়।
‘বউমা-’
‘বলুন’
উঁহু, গলার স্বরটা ঠিক কাছা-গলায় দেওয়ার মত নয়
বড্ড ন্যাড়া।
হঠাৎ এই দেমাক এলো কোত্থেকে?
বাপের বাড়ির কেউ তো
ভাইফোঁটার পর আর এদিক মাড়ায় নি?
বাড়িটা যেন ঝড়ের অপেক্ষায়
থমথম করছে।
ছোট ছেলে কলেজে;
মেজোটি সামনের বাড়ির রোয়াকে ব’সে
রাস্তায় মেয়ে দেখছে;
ফরসা ফরসা মেয়ে-
বউদির মত ভুশুন্ডি কালো নয়।
বালতি ঠনঠনিয়ে
বউ যেন মা-কালীর মত রণরঙ্গিণী বেশে
কোমরে আঁচল জড়িয়ে
চোখে চোখ রেখে শাশুড়ির সামনে দাঁড়ালো।
শাশুড়ির কেমন যেন
হঠাৎ গা ছমছম করতে লাগল।
তাড়াতাড়ি থলির মধ্যে হাতটা লুকিয়ে ফেলে
চোখ নামিয়ে বললেন: আচ্ছা থাক্ , এখন যাও।
বউ মাথা উঁচু ক’রে
গটগট ক’রে চলে গেল।
তারপর একা একা পা ছড়িয়ে ব’সে
মোটা চশমা কাঁথা সেলাই করতে করতে
শাশুড়ি এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় হয়ে ভাবতে লাগলেন
বউ হঠাৎ কেন বিগড়ে গেল
তার একটা তদন্ত হওয়া দরকার।
তারপর দরজা দেবার পর
রাত্রে
বড় ছেলের ঘরে আড়ি পেতে
এই এই কথা কানে এলো-
বউ বলেছে: ‘একটা সুখবর আছে।’
পরের কথাগুলো এতো আস্তে যে শোনা গেল না।
খানিক পরে চকাস চকাস শব্দ,
মা হয়ে আর দাঁড়াতে লজ্জা করছিলো।
কিন্তু তদন্তটা শেষ হওয়া দরকার-
বউয়ের গলা; মা কান খাড়া করলেন।
বলছে: ‘দেখো, ঠিক আমার মতো কালো হবে।’
এরপর একটা ঠাস করে শব্দ হওয়া উচিত।
ওমা, বউমা বেশ ডগমগ হয়ে বলছে:
‘কী নাম দেব, জানো?
আফ্রিকা।
কালো মানুষেরা কী কান্ডটাই না করছে সেখানে।।’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন