মানুষ জাগবে ফের
আনিসুল হক১.
হে তরুণ হে যুবক
হে শ্রমিক হে কৃষক
মেনো না হতাশা
আবার আসবে দিন সূর্যিত আলোর
আবার আসবে দিন সমূহ উজ্জ্বল
মানুষ জাগবে ফের জাগবে মানুষ।
২.
নিদারুণ দুঃসময়ে আমাদের অধিবাস আজ
নির্দয় সূর্যের তাপে ফেটে যায় মাটি ও মনন
কামরুলী জানোয়ার দাঁতে ঘষে দাঁত
জয়নুলের কাকেরা করে কা-কা স্বদেশভাগাড়ে
কাক ও কুকুর ছাড়া আর কোনো প্রাণী যেন নেই
হতাশা ও ধোঁয়া ছাড়া আর কোনো দৃশ্যকল্প নেই
মানুষ নিরাশ আজ মানুষের আস্থা নেই আলোকের প্রতি
মানুষ নিরন্ন আজ মানুষের আস্থা নেই অন্নদাত্রী মৃত্তিকার প্রতি।
চারিদিকে অন্ধকার ছিদ্রহীন শেষহীন অদ্ভুত আধাঁর
বিলাপ ও আর্তনাদ ছাড়া কোনো উচ্চারণ নেই
আপোষ ও বেইমানি ছাড়া কোনো রাজনীতি নেই
উৎকোচ ও দুর্নীতি ছাড়া কোনো কারবার নেই
সামরিক উর্দি ছাড়া আর কোনো ভগবান নেই।
মানুষ ঘুমিয়ে সব বেঘোরে অঘোরে যেন অনন্ত শয়নে।
তথাপি হে সাথি
হে কৃষক খেতের মজুর
ছাত্রবন্ধু
শ্রমজীবী মৌলিক মানুষ
হে কামার হে কুমোর জেলে তাঁতি মাঝিমাল্লা কুলি
একবার প্রাণ খুলে কান পেতে ধরো
একবার অন্তর্দৃষ্টি মেলে ধরে দ্যাখো
শুনতে পাও কি না
বাজে সেই অগ্নিবীণা
নয় কোনো মায়াবী আহ্বান
নয় কোনো অলৌকিক দেবদূত বাণী
মানুষের কণ্ঠ থেকে বজ্র উঠে আসে
মানুষের কণ্ঠ থেকে অগ্নি উঠে আসে
আবার মিনতি করি কান পেতে শোনো
শোনা যায় জাগরণী আজান অভয়
‘জয়বাংলা, বাংলার জয়-য়’
৩.
দারুণ দুখের দিনে আজ
দারুণ হতাশ রাতে আজ
একদিকে স্বজনের লাশ নিয়ে কেঁদে মরে গরিষ্ঠ মানুষ
অন্যদিকে দাঁত ঘষে সাম্রাজ্যবাদের প্রহরীরা
মুমূর্ষু পুঁজিবাদের শেষরক্ষা হয়ে
পোষ্য ভৃত্যগণ হেলমেট পরিধান করে
কেড়ে নেয় মানুষের জন্ম অধিকার
অথচ মিছিল নেই মানুষের জাগ্রত মিছিল
নেই ব্যারিকেড কোনো।
তথাপি সারথি প্রিয় হে তরুণ
তথাপি বাঙালি ভাই
হে যুবক
একবার ইতিহাস থেকে পাঠ করে দ্যাখো
সেই অমিত ভাষণ
সেই যে সাতই মার্চ
আর সেই কণ্ঠ মানবিক
‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’
৪.
মানুষের জাগরণে অবিশ্বাস করো না মানুষ
মানুষের উদয়নে অনাস্থা এনো না বন্ধু
মানুষের উদ্বোধনে অবিশ্বাসী হয়ো না মানুষ
মানুষের উজ্জীবনে আস্থাহীন হয়ো না সারথি
মানুষ জাগবে ফের।
৫.
মানুষ কি জাগে নাই অন্ধকার তাড়ানিয়া সূর্যের মতন
মানুষ কি জাগে নাই তুফানের প্রচ- গতিতে
জীবন কি জাগে নাই মরণের আবরণ ভেঙে
জীবন কি জাগে নাই বারুদের বিস্ফোরণ ঠেলে?
মানুষ জাগ্রত হয় মানুষের ডাকে
মানুষকে জাগিয়ে দেয় স্বপ্নে দেখা রাজদূত নয়
মায়াবী যাদুর কাঠি তা-ও নয়
মানুষ জাগ্রত হয় সময়ের হাঁকে
নদী প্রবাহিত হয় তার
দুই তীরে সবখানে গড়ে না বন্দর
বন্দর গঠিত হয় কোনো এক বাঁকে
সময় এখন কালো
মানুষ ঘুমিয়ে সব
চারদিকে নিশাচর পশু
তার মানে এই নয় কোনো দিন জাগবে না কেউ
সমাজের গতি চলে দেয়ালের ঘড়ির মতন
কেবলই সময় হলে ঘণ্টা বেজে ওঠে
এখন কেবলই শব্দ টিক টিক টিক
তাই বলে এই নয় ঘণ্টা আর বাজবে না কভু
বায়ান্নোয় একদিন জেগেছিল সব
আবার আসেনি কি মহাজাগরণ
সুমহান একাত্তরে?
স্বর্গ থেকে নয়
মানুষের মাঝ থেকে
মানবিক কণ্ঠ কি হে গর্জে ওঠে নাই
‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’
৬.
মানুষের জাগরণ অপূর্ব বিশাল
সবকিছু ভেঙেভুঙে সাজায় নিজস্ব ঢঙে
ঈশ্বরের ভয়ভীতি নিষেধাজ্ঞা তুচ্ছ হয়ে যায়
উনিশশ একাত্তর
তার উজ্জ্বল প্রমাণ
মানুষের জাগরণ অপূর্ব সুন্দর
মুমূর্ষু বিড়াল যেন বাঘ হয়ে যায়
যে জাতি কখনো
ইতিহাসে কোনো দূর অতীতেও
পররাজ্যে করেনি হামলা
সে জাতিও অস্ত্র তুলে নেয়
৭.
“কলিমুদ্দি শেখ মুই অমপুরে আবাস হামার
বিশ্বাস কি হয় বাহে এই মুই যুদ্ধে গেছিলাম
মুই তো একলা নও অনেকেই আছিল সাথোত
লাঙ্গল ফেলিয়া বাহে এই হাতে অস্ত্র নিছিলাম।
সময় দিয়াছে ডাক হামার কি সাধ্য বসি থাকিব ঘরোত
ঘরের বাহির হয়া ঝাঁপ দিই আকুল গাঙেতে
চোখে মোর এক ছবি সামনের তীরেতে নতুন
জীবন আছে তো এক সোনার খাঁচায় নয়
কেমন স্বাধীন এক নতুন জীবন,
আকুল বানের তোড়ে ভাসি ভাসি যুদ্ধে চলি যাই
হামার দ্যাশের লাগি কলিম কিষান মুই যুদ্ধে চলি যাই
মরণের ভয়ডর ফেলি মুই যুদ্ধে চলি যাই
দুমুঠা ভাতের লাগি যুদ্ধে চলি যাই
বুকের ভেতরে মোর ‘জয় বাংলা’ জ্বালি দ্যায়
জানি না এ কিসের আগুন”
৮.
দারুণ মিছিল আসে মানুষের মুক্তির মিছিল
আসে চাষা আসে চাষি অস্ত্র তুলে নেয়
আসে ছাত্র আসে যুবা অগ্নি জ্বেলে দ্যায়
আসে মাতা আসে বধূ দাহ ঢেলে দ্যায়
আসে মাঝি আসে মাল্লা মুক্তির নৌকায়
শ্রমিক মজুর আসে আসে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি আসে
ঘরে ঘরে জেগে ওঠে একেকটি শেখ মুজিবর
৯.
একাত্তরে জেগে ওঠে অযুত বাঙালি
তার সাথে হাত ধরে প্রতিরোধ গড়ে তোলে হরিৎ প্রকৃতি
সবুজ পত্রালি তার গহন শ্যামলে ঢাকে গেরিলারা সশস্ত্র শরীর
উত্তাল নদীরা ভাঙে আগ্রাসীর ক্রূর যোগাযোগ
তীব্র স্রোতে ঢেউয়ে ঢেউয়ে
গড়ে তোলে দৃঢ় প্রতিরোধ
বাংলার জোনাকি সব গেরিলাদের দেখায় আলো
মৃত্তিকা বুকের মাঝে মুক্তিদের ধরে রাখে যেন-বা বাংকার
বাংলার প্রান্তর ফুল ফল
ভাত পানি
বৃক্ষ নদী পাখি ও পতঙ্গ
মানুষের জাগরণে
জেগে ওঠে নিজস্ব মহিমে
১০
আবার আসবে সেই সময়ের বাঁক
আবার আসবে সেই জাগরণী ধবল প্রহর
ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের দোহাই
অযুত বীরাঙ্গনার সম্ভ্রমের কিরা
আবার আসবে এক মহান প্লাবন
জন্ম নেবে আর একবার
শেখ মুজিবর
ইতিহাসের প্রগতি রুদ্ধ করে শক্তি আছে কার
মানুষের অগ্রযাত্রা বন্ধ করে সাধ্য আছে কার
মানুষ জাগবে ঠিক
পুনরায় জাগবে মানুষ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন