সোমবার, ৯ জুন, ২০১৪

আট বছর আগে একদিন - জীবনানন্দ দাস


আট বছর আগে একদিন

জীবনানন্দ দাশ

শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে- ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হ’ল তার সাধ।

বধূ শুয়ে ছিল পাশে- শিশুটিও ছিল;
প্রেম ছিল, আশা ছিল -জোৎস্নায় -তবু সে দেখিল
কোন্ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল -লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।

এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি!
রক্তফেনা-মাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মত ঘাড় গুঁজি
আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় এবার;
কোনদিন জাগিবে না আর।


‘কোনদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম-অবিরাম ভার
সহিবে না আর-’
এই কথা বলেছিল তারে,
চাঁদ ডুবে চ’লে গেলে -অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মত কোন এক নিস্তব্ধতা এসে।

তবুও তো প্যাঁচা জাগে;
গলিত স্থবির ব্যাং আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
কয়েকটি প্রভাতের ইশারায় -অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।

টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে
চারিদিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা;
মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালবাসে।

রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি;
সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কত দেখিয়াছি।

ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন-যেন কোন বিকীর্ণ জীবন
অধিকার ক’রে আছে ইহাদের মন;
দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িংয়ের ঘন শিহরন
মরণের সাথে লড়িয়াছে,
চাঁদ ডুবে গেলে ’পরে প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে
এক গাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা একা;
যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের - মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা,
-এই জেনে।

অশ্বত্থের শাখা
করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকীর ভিড় এসে সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে
করেনি কি মাখা মাখি?
থুরথুরে অন্ধ প্যাঁচা এসে
বলেনি কি ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে?
চমৎকার!
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার!’
জানায়নি কি প্যাঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার?

জীবনের এই স্বাদ -সুপক্ক যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের-
            তোমার অসহ্য বোধ হল;
মর্গে কি হৃদয় জুড়োলো
মর্গে -গুমোটে
থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্ত-মাখা ঠোটে!
শোনো
তবু এ মৃতের গল্প; -কোনো
নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;
বিবাহিত জীবনের সাধ
কোথাও রাখেনি কোনো খাদ।
সময়ের উদ্বর্তনে উঠে এসে বধূ
মধু -আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে;
হাড়হাভাতের গ্লানি বেদনার শীতে
এ-জীবন কোনোদিন কেঁপে ওঠে নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ‘পরে।

জানি -তবু জানি
নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছ্বলতা নয়-
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে;
ক্লান্ত-ক্লান্ত করে;
লাশকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই,
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে।

তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি, আহা,
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বত্থের ডালে বসে এসে,
চোখ পাল্টায়ে কয়: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে?
চমৎকার!
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার-!’

হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মতো বুড়ো হব - বুড়ি চাঁদটারে আমি
ক’রে দেব কালীদহে বেনোজলে পার;
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চ’লে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ক্লিক করলেই ইনকাম