অন্ধ বধূ
যতীন্দ্রমোহন বাগচী (১৮৭৮-১৯৪৮)পায়ের তলায় নরম ঠেকল কী!
আস্তে একটু চল্ না ঠাকুর-ঝি-
ওমা, এ যে ঝরা-বকুল! নয়?
তাইতো বলি, বসে দোরের পাশে,
রাত্তিরে কাল-মধুদির বাসে
আকাশ-পাতাল-কতই মনে হয়।
জষ্ঠি আসতে কদিন দেরি ভাই-
আমের গায়ে বরণ দেখা যায়?
-অনেক দেরি? কেমন করে হবে!
কোকিল-ডাকা শুনেছি সেই কবে,
দখিন হাওয়া-বন্ধ কবে ভাই;
দীঘির ঘাটে নতুন সিঁড়ি জাগে-
শেওলা-পিছল-এমনি শঙ্কা লাগে,
পা-পিছলে তলিয়ে যদি যাই!
মন্দ নেহাৎ হয় না কিন্তু তায়-
অন্ধ চোখের দ্বন্দ্ব চুকে যায়!
দুঃখ নাইকো সত্যি কথা শোন্,
অন্ধ গেলে কী আর হবে বোন?
বাঁচবি তোরা-দাদা তো তোর আগে?
এই আষাঢ়েই আবার বিয়ে হবে,
বাড়ি আসার পথ খুঁজে না পাবে-
দেখবি তখন- প্রবাস কেমন লাগে?
-কী বললি ভাই, কাঁদবে সন্ধ্যা-সকাল?
হা অদৃষ্ট, হায়রে আমার কপাল!
কত লোকই যায় তো পরবাসে-
কাল-বোশেখে কে না বাড়ি আসে?
চৈতালি কাজ, কবে যে সেই শেষ!
পাড়ার মানুষ ফিরল সবাই ঘর,
তোমার ভায়ের সবই স্বতন্তর-
ফিরে আসার নাই কোনো উদ্দেশ!
-ঐ যে হেথায় ঘরের কাঁটা আছে-
ফিরে আসতে হবে তো তার কাছে!
এই খানেতে একটু ধরিস ভাই,
পিছল ভারি-ফসকে যদি যাই-
এ আমার রক্ষা কি আর আছে!
আসুন ফিরে-অনেক দিনের আশা,
থাকুন ঘরে, না থাক ভালোবাসা-
তবু দুদিন অভাগিনীর কাছে!
জন্মশোধের বিদায় নিয়ে ফিরে-
সেদিন তখন আসব দীঘির তীরে।
‘চোখ গেল’ ঐ চেঁচিয়ে হল সারা।
আচ্ছা দিদি, কী করবে ভাই তারা-
জন্ম লাগি গিয়েছে যার চোখ!
কাঁদার সুখ যে বারণ তাহার-ছাই!
কাঁদতে পেলে বাঁচত সে যে ভাই,
কতক তবু কমত যে তার শোক!
‘চোখ গেল’-তার ভরসা তবু আছে-
চক্ষুহীনার কী কথা কার কাছে!
টানিস কেন? কিসের তাড়াতাড়ি-
সেই তো ফিরে যাবো আবার বাড়ি,
একলা থাকা সেইতো গৃহকোণ-
তার চেয়ে এই স্নিগ্ধ শীতল জলে
দুটো যেন প্রাণের কথা বলে-
দরদ-ভরা দুখের আলাপন;
পরশ তাহার মায়ের স্নেহের মতো
ভুলায় খানিক মনের ব্যথা যত!
এবার এলে, হাতটি দিয়ে গায়ে
অন্ধ আঁখি বুলিয়ে বারেক পায়ে-
বন্ধ চোখের অশ্রু রুধি পাতায়,
জন্ম-দুখীর দীর্ঘ আয়ু দিয়ে
চির-বিদায় ভিক্ষা যাব নিয়ে-
সকল বালাই বহি আপন মাথায়!
দেখিস তখন, কানার জন্য আর
কষ্ট কিছু হয় না যেন তাঁর।
তারপরে-এই শেওলা-দীঘির ধার-
সঙ্গে আসতে বলব নাকো আর,
শেষের পথে কিসের বল ভয়-
এইখানে এই বেতের বনের ধারে,
ডাহুক-ডাকা সন্ধ্যা-অন্ধকারে-
সবার সঙ্গে সাঙ্গ পরিচয়।
শেওলা-দীঘির শীতল অতল নীরে-
মায়ের কোলটি পাই যেন ভাই ফিরে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন