আমাদের মা
হুমায়ুন আজাদ |
আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।
আমাদের মা গরিব প্রজার মতো দাঁড়াতো বাবার সামনে
কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতো না
আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে
মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি।
আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিল,
কিন্তু ছিলো আমাদের সমান,
আমাদের মা ছিলো আমাদের শ্রেণীর,
আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের।
বাবা ছিলেন অনেকটা আল্লাহর মতো,
তার জ্যোাতি দেখলে আমরা সেজদা দিতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা সিংহের মতো,
তাঁর গর্জনে আমরা কাঁপতে থাকতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা আড়িয়ল বিলের প্রচন্ড চিলের মতো,
তার ছায়া দেখলেই
মুরগির বাচ্চার মতো আমরা মায়ের ডানার নিচে লুকিয়ে পড়তাম।
ছায়া স’রে গেলে আবার বের হয়ে আকাশ দেখতাম।
আমাদের মা ছিলো অশ্রুবিন্দু-দিনরাত টলমল করতো
আমাদের মা ছিলো বনফুলের পাপড়ি-সারাদিন ঝ’রে ঝ’রে পড়তো
আমাদের মা ছিলো ধানক্ষেত-
সোনা হ’য়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকতো
আমাদের মা ছিলো দুধভাত-
তিন বেলা আমাদের পাতে ঘন হয়ে থাকতো
আমাদের মা ছিলো ছোট্ট পুকুর-
আমরা তাতে দিনরাত সাঁতার কাটতাম
আমাদের মার কোনো ব্যক্তিগত জীবন ছিলো কি না আমরা জানি না
আমাদের মাকে আমি কখনো বাবার বাহুতে দেখি নি
আমি জানি না
মাকে জড়িয়ে ধ’রে বাবা কখনো চুমো খেয়েছেন কি না
চুমো খেলে মার ঠোঁট ওরকম শুকনো থাকতো না।
আমরা ছোট ছিলাম, কিন্তু বছর বছর আমরা বড় হ’তে থাকি
আমাদের মা বড়ো ছিলো, কিন্তু বছর বছর মা ছোট হ’তে থাকে।
ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময়ও আমি ভয় পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতাম।
সপ্তম শ্রেণীতে ওঠার পর ভয় পেয়ে মা
একদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে।
আমাদের মা দিনদিন ভয় পেতে থাকে।
আমাদের মা আর বনফুলের পাপড়ি নয়,
সারাদিন ঝ’রে ঝ’রে পড়ে না
আমাদের মা আর ধানক্ষেত নয়, সোনা হ’য়ে বিছিয়ে থাকে না
আমাদের মা আর দুধভাত নয়,
আমরা আর দুধভাত পছন্দ করি না
আমাদের মা আর ছোট্ট পুকুর নয়,
পুকুরে সাঁতার কাটতে আমরা কবে ভুলে গেছি
কিন্তু আমাদের মা, আজো অশ্রুবিন্দু, গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত
আমাদের মা আজো টলমল করে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন