রবিবার, ২৫ মে, ২০১৪

বাচস্পতি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


বাচস্পতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

-দাদামশায়, তুমি তোমার চার দিকে যে-সব পাগলের দল জমিয়েছিলে, গুণ হিসেব ক'রে তাদের বুঝি সব নম্বর দিয়ে রেখেছিলে?
-হ্যাঁ, তা করতে হয়েছে বৈকি। কম তো জমেনি।
-তোমার পয়লা নম্বর ছিলেন বাচস্পতি মশায়, তাঁকে আমার ভারি মজা লাগে।


-আমার শুধু মজা লাগে না, আশ্চর্য লাগে। কারণ বলি- কবিতা লিখে থাকি। কথা বাঁকানো-চোরানো আমাদের ব্যাবসা। যে শব্দের কোনো সাদা মানে আছে তাকে আমরা ধ্বনি লাগিয়ে তার চেহারা বদল করি। সে একরকমের যাদুবিদ্যা বললেই হয়। কাজটা সহজ নয়। আমাদের বাচষ্পতি আমাকে আশ্চর্য করে দিয়েছিলেন যখন দেখলুম তিনি একেবারে গোড়াগুড়ি ভাষা বানিয়েছেন। কান দিয়ে ধ্বনির রাস্তায় তার মনের রাস্তা খুঁজতে হয়। আমাদের কাজটাও অনেকটা তাই, কিন্তু এতদূর পর্যন্ত নয়। আমরা তবু ব্যাকরণ অভিধান মেনে চলি। বাচস্পতির ভাষা চলত সে-সমস্তই ডিঙিয়ে। শুনলে মনে হত যেন কী একটা মানে আছে। -মানে ছিল বৈকি। কিন্তু, সেটা কানের সঙ্গে ধ্বনি মিলিয়ে আন্দাজ করতে হত। আমার ‘অদ্ভুত-রত্নাকর’ সভার প্রধান পন্ডিত ছিলেন বাচস্পতি মশায়। প্রথম বয়সে পড়াশুনা করেছিলেন বিস্তর, তাতে মনের তলা পর্যন্ত গিয়েছিল ঘুলিয়ে। হঠাৎ একসময়ে তাঁর মনে হল, ভাষার শব্দগুলো চলে অভিধানের আঁচল ধ'রে। এই গোলামি ঘটেছে ভাষার কলিযুগে। সত্যযুগে শব্দগুলো আপনি উঠে পড়ত মুখে। সঙ্গে সঙ্গেই মানে আনত টেনে। তিনি বলতেন, শব্দের আপন কাজই হচ্ছে বোঝানো, তাকে আবার বোঝাবে কে। একদিন একটা নমুনা শুনিয়ে তাক লাগিয়ে দিলেন। বললেন, ‘আমার নায়িকা যখন নায়ককে বলেছিল হাত নেড়ে ‘দিন রাত তোমার ঐ হিদ্হিদ্-হিদিক্কারে আমার পাঁজঞ্জুরিতে তিড়িতঙ্ক লাগে’ তখন তার মানে বোঝাতে পন্ডিত ডাকতে হয়নি। যেমন পিঠে কিল মেরে সেটাকে কিল প্রমাণ করতে মহামহোপাধ্যায়ের দরকার হয় না।
সভাপতি একদিন বিষয়টা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ওহে বাচস্পতি, সেই ছেলেটার কী দশা হল। বাচস্পতি বললেন,
সে ছেলেটার বুঝকিন্ গোড়া থেকেই ছিল বুঝভুম্বুল গোছের। তার নাম দিয়েছিলাম বিচ্কুম্কুর।
মথুরবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ও নামটা কেন। বাচস্পতি বললেন,
সে যে একেবারেই বিচ্কুম্কুর। পাঠশালার পেডেন্ডোকে দেখলেই তার আন্তারা যেত ফুস্কলিয়ে। বুকের ভিতরে করতে থাকত কুড়ুক্কুর কুড়ুক্কুর। এমন ছেলেকে বেশী পড়ালে সে একেবারেই ফুস্কে যাবে, একথাটা বলেছিল পাড়ার সবচেয়ে যে ছিল পেড়াম্বর হুডুমকি। একটু রসুন-বুঝিয়ে বলি। পেডেন্ডো কথাটা বালি দ্বীপের কাছে পেয়েছি। তাদের মুখের পন্ডিত শব্দটা আপনিই হয়ে উঠেছে পেডেন্ডো। ভেবে দেখুন, কত বড়ো ওজন, ওর বিদ্যের বোঝা ঠেলে নিয়ে যেতে দশ-বিশ জন ডিগ্রীধারী জোয়ানের দরকার হয়। আর পন্ডিত-ছোঃ, তুড়ি দিয়ে তুড়তুড়ং ক’রে উড়িয়ে দেওয়া যায়। অটলদা বললেন,
-বাচস্পতি, তোমার আজকেকার বর্ণনাটা একেবারেই চলতি গ্রাম্য ভাষায়। এ তোমাকে মানায় না। সেই সেদিন যে সাধু ভাষা বেরিয়েছিল তোমার মুখ দিয়ে, যার সধ্বংসৃনিত হার্দিক্যে বুধবুধিদের মন তিংতিড়ি তিংতিড়ি করে ওঠে, সেই ভাষার নমুনা আজ এদের শুনিয়ে দাও। যে-ভাষায় ভারতের ইতিহাসটি গেঁথেছ, যার গুরুভার হিসেব করে বলেছিলে ডুন্ডুম্মানিত ভাষা, তার পরিচয়টা চাই। শুনে এদের সকলের আন্তারা ফাঁচ্কলিয়ে যাক। বাচস্পতি মশায় শুরু করলেন,
সম্মম্মরাট সমুদ্রগুপ্তের ক্রেঙ্কটাকৃষ্ট ত্বরিৎত্রম্যন্ত পর্যুগাসন উৎথ্রংসিত-
একজন সভাসদ বললেন, বাচষ্পতি মশায়, উল্থ্রংসিত কথাটা শোনাচ্ছে ভালো, ওর মানেটা বুঝিয়ে দিন।
পন্ডিতজী বললেন-ওর মানে উৎথ্রংসিত।
-তার মানে?
-তার মানে উৎথ্রংসিত।
-অর্থাৎ?
-অর্থাৎ, তার মানে হতেই পারে না। মেরে-কেটে একটা মানে দিতেও পারি।
কী রকম।
-ভিরভ্রিংগট্ট।
-আর বলতে হবে না, স্পষ্ট বুঝেছি, বলে যান। বাচস্পতি আবার শুরু করলেন,
-সম্মম্মরাট সমুদ্রগুপ্তের ক্রেঙ্কটাকৃষ্ট ত্বরিৎত্রম্যন্ত পর্যুগাসন উৎথ্রংসিত নিরংকরালের সহিত-
-মথুরবাবুর মুখের দিকে চেয়ে বললেন কেমন মশায়, বুঝছেন তো নিরংকরাল-
-একেবারে জলের মতো। ওর চেয়ে বেশী বুঝতে চাই না-মুশকিল হবে। বাচস্পতি আবার ধরলেন,
-নিরংকরালের সহিত অজাতশত্রু অপরিপর্যম্মিত গর্গরায়ণকে পরমন্তি শয়নে সমুুসদ্গারিত করিয়াছিল।
-[সভাস্থ সকলের প্রতি] দেখুন একবার, সহজ কাকে বলে। অভিধানের প্রয়োজনই হয় না।
-প্রয়োজন হলেই বা পাব কোথায়।
-[মথুরবাবুর প্রতি] ভাবখানা বুঝেছেন তো?
-বুঝেছি বৈকি। সমুদ্রগুপ্ত অজাৎশত্রæকে আচ্ছা করে পিটিয়ে দিয়েছিলেন। আহা বাচস্পতি মশায়, লোকটাকে একেবারে সমুসদ্গারিত করে দিলে গো-একেবারে পরমন্তি শয়নে।
-ছোটোলাট একবার এসেছিলেন আমাদের পাড়ার স্কুলে বুটের ধূলো দিয়ে যেতে। তখন আমি তাকে এই বুগবুলবুলি ভাষার একটা ইংরেজী তর্জমা শুনিয়েছিলুম।
-[সভাস্থ সকলে] ইংরেজীটা শুনা যাক।
-দি হাব্বারফ্লুয়াস ইনফ্যাচুফুয়েশন অব আকবার, ডর্বেন্ডিক্যালি ল্যাসেরটাইজট্ দি গর্ব্যান্ডিজম্ অফ হুমায়ুন। শুনে ছোটোলাট একেবারে টরেটম্ বনে গিয়েছিলেন; মুখ হয়েছিল চাপা হাসিতে ফুস্কায়িত। হেড পেডেন্ডোর টিকির চার ধারে ভেরেন্ডম্ লেগে গেল, সেক্রেটারি চৌকি থেকে তড়তং করে উৎখিয়ে উঠলেন। ছেলেগুলোর উজবু¤মখো ফুড়ফড়োমি দেখে মনে হল, তারা যেন সব ফিরিচুঞ্চুসের একেবারে চিকচাকস্ আমদানি। গতিক দেখে আমি চংচটকা দিলুম।
-[সভাপতি] বাচস্পতি, এইখানেই ক্ষান্ত দাও হে, আর বেশীক্ষণ চললে পরাগগলিত হয়ে যাব। এখনি মাথাটার মধ্যে তাজ্মিম মাজ্মিম করছে।
বাচস্পতি আর কিছুদিন বেঁচে থাকলে সভাপতির ভাষা এতদিনে ওদের মুখবুদ্বুদী শব্দে রঝম্ গঝম্ করে উঠত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ক্লিক করলেই ইনকাম